এস সুদর্শনন, ক্রিকইনফো ।।
লরেন বেলের জীবনে ক্রিকেট আসলে হয়েছিল আকস্মিকভাবেই। স্বভাবগতভাবে অ্যাথলেটিক আর প্রতিযোগীতাপ্রবণ বেল বড় হতে হতে একাধিক খেলায় অংশ নিতেন—শুধু আনন্দের জন্য। প্রচুর ফুটবল আর সামান্য ক্রিকেট, ব্যস। ইংল্যান্ড দলে খেলার স্বপ্ন তখনো কোনো স্পষ্ট লক্ষ্য ছিল না; সবকিছু যেন নিজে নিজেই ঘটেছে।
“আপনি যদি সাত-আট বছরের ছোট্ট লরেনকে জিজ্ঞেস করতেন, সে সম্ভবত পুরো ফুটবল কিট পরে শিন গার্ড লাগিয়ে মাঠে দৌড়াচ্ছে,” গুয়াহাটিতে বসে ক্রিকইনফোকে বলেন বেল। “আমার নানা সবসময় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের জার্সি এনে দিতেন, আর আমি বাগানে দাঁড়িয়েই ফুটবল খেলতাম। অন্য বাচ্চারা যে যেভাবে সময় কাটায়, আমার কাছে মজা মানে ছিল খেলাধুলা করা।”

দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের একমাত্র টেস্টে নিয়েছিলেন ২ ইনিংসে ৮ উইকেট, হয়েছিলেন ম্যাচ সেরা
আট বছর বয়স থেকেই বেল রিডিং এফসি–র জুনিয়র দলে ফুটবল খেলতেন। একই সময়ে ক্রিকেটও খেলছিলেন, এবং বাবা–মা তাকে দুই খেলাতেই নিয়মিত প্র্যাকটিসে নিয়ে যেতেন। ২০১৭ সালে, কিয়া সুপার লিগ (KSL)–এর দ্বিতীয় আসরের পর সাউদার্ন ভাইপার্স তাকে তাদের উইন্টার ট্রেনিং ও পরবর্তী গ্রীষ্মে মূল দলে খেলার জন্য চুক্তির প্রস্তাব দেয়। কিন্তু অনুশীলনের সময় ছিল শনিবার সকাল, ঠিক একই সময়ে ছিল তার ফুটবল ম্যাচ।
“আমার বাবা–মা বললেন, ‘একটা বেছে নিতে হবে, কারণ দুই জায়গায় একই সময়ে যাওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব না।’ তখনই আমি সিদ্ধান্ত নিই, ক্রিকেটটাই বেছে নেব,” বলেন বেল। “তারপর থেকে আর কখনো ফুটবল খেলিনি। একটু খারাপ লাগে, কিন্তু পেছনে তাকালে মনে হয় ঠিক সিদ্ধান্তই ছিল।”

অজি নির্ভরতা অ্যালিসা হিলিকে ফিরিয়ে উল্লাস
বেল প্রায় ছ’ফুট লম্বা—তাই তাকে ডাকনাম দেওয়া হয়েছে “দ্য শার্ড” (লন্ডনের সুউচ্চ Shard ভবনের নামে)। তিনি ভালো গতিতে বোলিং করতে পারেন এবং তার ইন–সুইং বেশ ভয়ংকর। তবে আগে তার বোলিং অ্যাকশনে একটি সমস্যা ছিল—ডেলিভারির পর শরীর ডান–বামের ভারসাম্য হারিয়ে বাম দিকে হেলে পড়ে যেতেন, এতে মাঝে মাঝে পিঠে ব্যথা হতো। গত বছর তিনি কঠোর পরিশ্রম করে অ্যাকশন রিমডেল করেন, এবং এখন তিনি উভয় দিকেই বল সুইং করাতে সক্ষম।
“আমি আগে ঠিক বুঝতেই পারিনি যে এত লম্বা হওয়াটা আমার জন্য কত বড় সুবিধা,” বেল বলেন। “শৈশব থেকেই আমি সবার চেয়ে অনেক লম্বা ছিলাম। তাই ফাস্ট বোলার হিসেবে এর যে বাড়তি সুফল পাওয়া যায়, সেটা তো ছিলই; কিন্তু কখনো ভাবিনি, ‘আমি লম্বা, তাই আমি ফাস্ট বোলার হবো।’ সবকিছু যেন ধাপে ধাপে নিজে থেকেই ঠিক হয়ে গেছে।”

নর্দাম্পটনের অনুশীলনে
তিনি আরও বলেন— “পেশাদার হওয়ার পরই আসলে আমি আমার কাজে গভীরভাবে ডুবতে শুরু করি। তার আগে ট্যালেন্ট আর কোচদের নির্দেশনায় খেলছিলাম, কিন্তু তখনো ফাস্ট বোলিংয়ের খুঁটিনাটি বোঝার সুযোগ হয়নি। এখন যখন স্কিল, অ্যাকশন আর মেকানিক্স বুঝতে শিখেছি, তখনই উপলব্ধি করেছি—আমার উচ্চতা, বাউন্স এবং স্থিতি আমাকে অন্য সব সিমারের থেকে আলাদা করে। এটা শুধু সুবিধা নয়, এটা আমাকে ‘আলাদা চিহ্ন’ দিয়েছে।”
উচ্চতার সুবিধা বোঝার পর তিনি মনোযোগ দিয়েছেন মূলত গতি বাড়ানো এবং সুইং নিয়ন্ত্রণে।
“আমি সাধারণত নতুন বলে বোলিং করি, আর সুইং করানোই আমার বড় অস্ত্র,” বলেন বেল। “আমরা সবসময় তিনটি জিনিস নিয়ে কথা বলি—গতি, বাউন্স এবং মুভমেন্ট। যদি এগুলো তোমার থাকে, তাহলে তোমাকে খেলা খুব কঠিন। আমার উচ্চতায় আমি বাউন্স পাই, শক্তি বাড়ালে গতি আরও বাড়বে, আর আমার হাতে বল সুইং করার দক্ষতাও আছে। আমি চাই বলকে দু’দিকেই মুভ করাতে। সুইং, পেস আর বাউন্স—এই তিনটাই আমাকে সবচেয়ে ভয়ংকর করে তোলে।”
বোলিং–দক্ষতার মতো বেলের ব্যক্তিত্বও তাকে আলাদা করে। বিশেষ করে তার চুলের স্টাইল—যা এখন অনেক তরুণী খেলোয়াড়কে অনুপ্রাণিত করছে প্ল্যাট বাঁধা চুলে খেলতে। বেল চান নারীদের ক্রিকেটে মেয়েরা নিজেদের “নারীসত্তা” প্রকাশ করুক নির্দ্বিধায়।

ক্যারিবীয়দের বিরুদ্ধে, টি-টোয়েন্টিতে
“আমি ছোটবেলা থেকেই চুল সাজাতে ভালোবাসি,” বলেন বেল। “আমি প্রথম যখন প্ল্যাট করা চুল নিয়ে টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে খেললাম, তারপর দ্য হান্ড্রেড–এ একইভাবে খেলি। সেখানেই দেখি ছোট ছোট মেয়েরা একই হেয়ারস্টাইল করে খেলা দেখতে এসেছে। তাদের মায়েরা এসে বলছেন—‘এখন আমাকে প্রতিদিন এই হেয়ারস্টাইল করে দিতে হয়!’—এমন জিনিসই আমাকে অনুপ্রাণিত করে। এটা আমার কাছে অনেক বড় ব্যাপার।”
তিনি আরও যোগ করেন— “আমি চাই ক্রিকেটকে মানুষ কুল মনে করুক, মেইনস্ট্রিম মনে করুক। ইচ্ছে করলে তুমি চুল সাজাতে পারো, মেয়েলি লুক রাখতে পারো, আবার ক্রিকেটও খেলতে পারো—এটা কোনো বাধা হওয়া উচিত নয়। ছোটবেলায় ক্রিকেটকে ‘ছেলেদের খেলা’ বলা হত, কিন্তু সময় বদলেছে, এবং এটা বদলাতেই হবে। পরিচয় লুকানোর কী আছে?”
বেল সমাজবিজ্ঞান ও ক্রিমিনোলজি–তে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তিনি ডিগ্রি শেষ করেন ইংল্যান্ড দলে অভিষেকের আগেই, তবে থিসিস লেখার সময় তিনি ছিলেন ওমেন্স অ্যাশেজ স্কোয়াডে স্ট্যান্ডবাই এবং ২০২২ ওয়ানডে বিশ্বকাপের সঙ্গে যুক্ত।

যখন ইংলিশ নারীদের এ দলে খেলতেন
বেল বলেন — “স্কুলে থাকতে আমার বাবা–মা চেয়েছিলেন আমি ব্র্যাডফিল্ড কলেজে পড়ি, ভালো এ–লেভেল করি এবং কঠোর পড়াশোনা চালিয়ে যাই। আমার বড় বোন বিশ্ববিদ্যালয়ে গেছে, তাই আমিও সবসময় ভেবেছি আমাকেও বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হবে। তাই এ–লেভেল ভালোভাবে শেষ করে আমি লাফবরোতে ভর্তি হই।”
লাফবরো বেছে নেওয়ার কারণও ছিল ক্রিকেট–স্বপ্ন। “আমার মাথায় ক্রিকেট তখনও ছিল। সেখানে ট্রেনিং সুবিধা ভালো, তাই পড়াশোনা ও খেলা একসঙ্গে চালানো সহজ হবে ভেবেছিলাম। কিন্তু তখনো আমি পেশাদার ক্রিকেটার ছিলাম না। আমি শুধু এমন কিছু পড়তে চেয়েছিলাম যা আমি উপভোগ করি। ক্রিকেটার না হতে পারলে যেন এমন একটি বিষয় থাকে, যেটির পেছনে আমি হাঁটতে পারি।”
২০২০–২১ সালে কোভিডের কারণে ক্রিকেট কার্যত থমকে থাকায় প্রথম দুই বছর পড়াশোনা সহজ ছিল, কিন্তু তৃতীয় বছর এসে পরিস্থিতি বদলে যায়—কারণ তখনই তিনি ডাক পান ইংল্যান্ড ‘এ’ দলের হয়ে অস্ট্রেলিয়া সফরে, এবং কয়েকদিন পর শুরু হয় ওমেন্স অ্যাশেজ।
বেল বলেন — “নিউজিল্যান্ড–অস্ট্রেলিয়ার মতো স্বপ্নের দেশে গিয়ে থিসিস লেখা সত্যিই কঠিন ছিল। সবাই ঘুরছে, উপভোগ করছে, আর আমি ল্যাপটপ খুলে লেখালেখি করছি। জীবনে প্রথমবার অস্ট্রেলিয়া–নিউজিল্যান্ডে গিয়েছিলাম—দেখার লোভ ছিলো, কিন্তু আবার দায়িত্বও ছিল। কোভিডের কারণে সব ক্লাস অনলাইনে ছিল—এটা আমার জন্য সৌভাগ্য, তাই পড়ে ফেলতে পেরেছি। কিছু ডেডলাইন এক্সটেনশনও মিলে যায়। শেষ পর্যন্ত করতে পেরেছি—এটা ভেবে আমি গর্বিত।”

চলমান বিশ্বকাপে আলো ছড়াচ্ছেন
২০২২ সালের জুলাইয়ে আন্তর্জাতিক অভিষেকের পর থেকে ইংল্যান্ডের কোনো পেসার ওয়ানডেতে বেলের চেয়ে বেশি উইকেট নেয়নি। তার উইকেট সংখ্যা এখন ৪০। (কেট ক্রস ৩৯ উইকেট নিয়ে কাছাকাছি ছিলেন, কিন্তু তাকে বিশ্বকাপ দল থেকে বাদ দেওয়া হয়—ফলে বেল এখন পেস আক্রমণের নেতা।)
২০২৫ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের প্রথম দুই ম্যাচে তিনি নিয়েছেন—
- ১–২৪ বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা (৪ ওভার)
- ১–২৮ বনাম বাংলাদেশ (৭ ওভার)
এ দুটি ম্যাচই হয়েছিল গুয়াহাটির তুলনামূলক ধীর পিচে।
“দায়িত্ব আমাকে আরও শক্তিশালী করে,” বলেন বেল।
“হিদার (নাইট) থাকুক বা ন্যাট (সিভার–ব্রান্ট) — যখন আমাকে আক্রমণের নেতৃত্ব দেওয়া হয়, আমি নিজের ভেতর সবচেয়ে সেরা বেলকে খুঁজে পাই। ম্যাচে প্রভাব ফেলতে পারাটাই আমার সবচেয়ে বড় তৃপ্তি।”
ইংল্যান্ড এখন যাচ্ছে কলম্বোতে, যেখানে ধীর পিচ তার সুইং–বোলিংকে আবারও পরীক্ষা করবে। একসময় যে লরেন বেল পুরোদস্তুর ফুটবলার হতে চাইতেন, সেই বেল এখন ইংল্যান্ডের নতুন বলের আশা–ভরসা। ইংল্যান্ড চাইবে—এবারও যেন সবকিছু “অটোমেটিক”—হয়ে যায়, ঠিক তার জীবনের আগের সিদ্ধান্তগুলোর মতোই।