চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি ।।
রাজশাহীগামী একটি বাসে ডাকাতির সময় ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে বলে কিছু গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ করলেও, সেই নারী নিজেই এ ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, তাঁর সঙ্গে এ বিষয়ে কেউ কথা বলেননি এবং ভুল তথ্য প্রচারের কারণে তিনি সামাজিকভাবে হেয় হচ্ছেন ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। তাঁর ভাষায়, ‘আমার টাকা-পয়সা–গয়না কেড়ে নেওয়াতে দুঃখ পাইনি, কিন্তু ধর্ষণের মিথ্যা খবর প্রচারে আমি ভেঙে পড়েছি।’
বুধবার সন্ধ্যায় চাঁপাইনবাবগঞ্জের মহানন্দা নদীর ধারে কথা বলেন ওই নারী। তিনি তখন একটি কীর্তনের অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য রওনা হয়েছিলেন।
ওই নারী বলেন, ‘এই যে আমার নামে কলঙ্কটা দেওয়া হলো, এটা তো সত্যি না। কত টেনশনে আছি, আমার স্বামী অসুস্থ। অ্যাকসিডেন্টে পা ভেঙে গেছে, পুরো পায়ে রিং পরানো আছে। সে ঘরে থাকে। অথচ মিডিয়াতে ছড়ানো হয়েছে, আমার স্বামী নাকি সেদিন আমার সঙ্গে ছিল এবং ডাকাতরা তাঁকে মারধর করে আমাকে ধর্ষণ করেছে। বাস্তব তো তা নয়। আমার স্বামী প্রায় এক বছর ধরে বিছানায় অসুস্থ হয়ে আছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার সমাজের কাছে মুখ দেখানোই কঠিন হয়ে গেছে। আমার শ্বশুরবাড়ির সবাই আমাকে খারাপ নজরে দেখছে। এভাবে যদি সবাই চলতে থাকে, তাহলে আমি সমাজে মুখ দেখাতে পারব না। বেঁচে থাকার মতো পরিবেশ থাকবে না আমার। আমার সঙ্গে যদি এমন কিছু হতো, আমি নিজেই প্রতিবাদ করতাম। কিন্তু আমার সঙ্গে যেটা হয়নি, তা আমার মাথায় চাপানো হচ্ছে। তাহলে এটা কেমন করে হয়? আমি কীভাবে এই সমাজে মুখ দেখাব? আমার অনুরোধ, সবাই যেন আমার পাশে এসে দাঁড়ায়।’
তিনি আকুতি জানিয়ে বলেন, কোনো নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, এটা বলার আগে যেন সংশ্লিষ্ট নারীর মুখ থেকে সত্য ঘটনা শোনা হয়। তিনি অনুরোধ করে বলেন, ‘ভেবেচিন্তে কথা বলুন, কারণ এটা একটা নারীর মানসম্মানের প্রশ্ন। মিডিয়া যদি এমন ভুল তথ্য ছড়ায়, তাহলে ভুক্তভোগীর কী হবে?’
নিজের পারিবারিক অবস্থার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, তাঁরা দুই বোন। বড় বোনের স্বামী লিভার ক্যানসারে মারা গেছেন। তাঁর স্বামী এক বছর ধরে অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন। সংসারের খরচ চালাতে তিনি কীর্তন করেন, গান গেয়ে কিছু অর্থ উপার্জন করেন। তিনি বলেন, ‘আগে গান করতাম মনের আনন্দে, এখন সংসার চালানোর জন্য গাইতে হয়। স্বামীর চিকিৎসায় আমাদের সব টাকা শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু আমরা গরিব হতে পারি, আমাদের সম্মানটাই বড়। এখন সেই সম্মানটাও নষ্ট করে দেওয়া হলো। তাহলে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কী মানে?’
১৭ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের বড়াইগ্রাম এলাকায় রাজশাহীগামী একটি বাসে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। ওই নারী জানান, তাঁরা সাভারের হেমায়েতপুর থেকে বাসে উঠেছিলেন। ডাকাতেরা অস্ত্রের মুখে যাত্রীদের কাছ থেকে টাকা, মোবাইল ফোন ও গয়না ছিনিয়ে নেয়। তাঁকেও ছয়-সাতবার শরীর তল্লাশি করা হয় এবং তাঁর হাতে থাকা সিটি গোল্ডের চুড়িগুলো ছিনিয়ে নেওয়া হয়।
তিনি বলেন, ‘চুড়ি খুলতে গিয়ে আমার হাতে আঘাত লাগে, ব্যথায় আমি চিৎকার করি। হয়তো এই চিৎকার শুনে অনেকে ভেবে নিয়েছেন যে আমার সঙ্গে অন্য কিছু হয়েছে। কিন্তু আমি থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে গিয়েও বলেছি, আমার হাতে আঘাত ছিল, তাই চিৎকার করেছিলাম। আমার জানা মতে, কেউ ধর্ষণের শিকার হয়নি। হ্যাঁ, নারীদের ওপর নির্যাতন হয়েছে, ডাকাতরা মেয়েদের দেহ তল্লাশি করেছে, কিন্তু ধর্ষণ হয়নি।’
ওই নারী বারবার স্পষ্ট করে বলেন, তিনি ধর্ষণের শিকার হননি। তারপরও গণমাধ্যমে প্রচারিত বিভ্রান্তিকর সংবাদের কারণে তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। তিনি বলেন, ‘মিডিয়াতে যখন বলা হয়েছে, তখন কিছু না কিছু তো হয়েছে—এমন ভাবছে সবাই। এখন কেউ আমার কথা বিশ্বাস করতে চাইছে না। অথচ আমার সঙ্গে যারা ছিল, তারা তো সব দেখেছে। এখন কীভাবে মিডিয়ার কথা সত্য হয়, আর আমার কথা মিথ্যা হয়?’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার জীবন এখন দুর্বিষহ হয়ে গেছে। আমি সমাজের কাছে ছোট হয়ে গেছি। আমার স্বামী অসুস্থ, পরিবারের কেউ আমাকে বিশ্বাস করতে চাইছে না। আমি চাই, সত্য কথাটা সবার সামনে আসুক।’
রাজশাহীগামী বাসে ডাকাতির সময় নারীদের ওপর নির্যাতন ও হয়রানির ঘটনা ঘটলেও ধর্ষণের অভিযোগের কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। সংশ্লিষ্ট নারী নিজেই গণমাধ্যমে প্রচারিত তথ্যকে মিথ্যা বলে দাবি করেছেন এবং সঠিক তথ্য যাচাই না করেই সংবাদ প্রকাশ করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তিনি সকলের কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন, যেন ভুল তথ্য প্রচার না করা হয় এবং তাঁর সম্মান রক্ষায় সহযোগিতা করা হয়।