স্টাফ রিপোর্টার ।।
শাহবাগে অবস্থিত শহীদ জিয়া শিশুপার্কের সংস্কার ও আধুনিকীকরণের জন্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ৭৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দিতে চেয়েছিল। এই অর্থ একটি প্রকল্পের আওতায় ছিল, যাতে শিশুদের পার্কের নিচ দিয়ে ভূগর্ভস্থ পার্কিং নির্মাণ করা হবে। তবে, এ প্রক্রিয়ায় পার্কের কিছু রাইড ক্ষতিগ্রস্ত হবে। নতুন রাইডের জন্য এবং পার্কের আধুনিকীকরণের খরচে এই টাকা দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু সিটি করপোরেশন জানায়, এত ‘অল্প টাকায়’ আধুনিকীকরণের কাজ সম্ভব নয় এবং তারা প্রস্তাবটি ফিরিয়ে দেয়। সে সময় মোহাম্মদ সাঈদ খোকন মেয়র ছিলেন।
এরপর ২০২০ সালের মে মাসে শেখ ফজলে নূর তাপস ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়রের দায়িত্ব নেন। কিছুদিন পরে তিনি মন্ত্রণালয়ের সেই প্রস্তাবটি সম্পর্কে জানতে পারেন; তবে তিনিও ৭৮ কোটি টাকা না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ঠিক করেন, শিশুপার্কের আধুনিকীকরণের কাজ সিটি করপোরেশন নিজেই করবে। পরে, তার উদ্যোগে ৬০৩ কোটি ৮১ লাখ টাকার একটি প্রকল্প তৈরি করা হয়।
ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে, তাপস ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রকল্পটি অনুমোদন করিয়ে নেন। প্রকল্পটি পাস হওয়ার সময় ঠিক হয়, ৬০৩ কোটি ৮১ লাখ টাকার মধ্যে ৪৮৩ কোটি টাকা সরকার দেবে। সরকারের দেওয়া টাকার অর্ধেক হবে অনুদান এবং বাকিটা ঋণ হিসেবে দেওয়া হবে। আর দক্ষিণ সিটির নিজস্ব তহবিল থেকে ১২০ কোটি টাকা খরচ করা হবে।
এই প্রকল্পের বেশিরভাগ ব্যয় (৪৪১ কোটি টাকা) শিশুপার্কের জন্য ১৫টি রাইড কেনা ও স্থাপনের জন্য ধরা হয়েছে। তবে রাইডের দাম নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বেসরকারি বিনোদনকেন্দ্র পরিচালনার সঙ্গে জড়িত তিনজন উদ্যোক্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, রাইডের যে দর দেখানো হয়েছে, তা অবিশ্বাস্য। সরকারি কাজ হওয়ায় এখানে অস্বাভাবিকভাবে বেশি দাম ধরা হয়েছে।
প্রকল্পে উল্লেখ করা হয়েছে, একসঙ্গে ৩০ জন চড়তে পারে এমন একটি রাইড ‘মাইন ট্রেন’ (মাইন কোস্টার নামেও পরিচিত) কেনা ও স্থাপন করতে ৯৭ কোটি টাকা খরচ হবে। কিন্তু এই রাইডের জন্য প্রকল্পে যে ধরনের বৈশিষ্ট্য ও মানের কথা বলা হয়েছে, তাতে এর দাম কোনোভাবেই ৫ কোটি টাকার বেশি হবে না। ঢাকা ও এর আশপাশের চারটি বড় বিনোদনকেন্দ্র পরিচালনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
মাইন ট্রেনের দাম কত হতে পারে, তা জানতে পরে চীনের দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ই-মেইলে যোগাযোগ করা হলে হেনান স্নোডার অ্যামিউজমেন্ট রাইডস কোম্পানি লিমিটেড জানিয়েছে, ৩০ আসনের একটি মাইন ট্রেন (সিটি করপোরেশনের দেওয়া বিবরণসহ) বাংলাদেশে এসে স্থাপন করার জন্য ব্যয় হবে ৫ কোটি ৯০ লাখ টাকা। অন্যদিকে আরেকটি প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, খরচ হবে ৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে এসব যন্ত্র আনার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এ জন্য দাম বেশি পড়ছে। তবে দরপত্রের মাধ্যমে কম দামে যন্ত্র কেনা গেলে তাঁরা সেটা কিনবেন।
এই প্রকল্পে ‘১২ডি থিয়েটার’ (দর্শকের কাছে মনে হবে সবকিছুই যেন জীবন্ত) স্থাপন করতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৮১ কোটি টাকা। এই থিয়েটারের ভেতরে একসঙ্গে ৩৬ জন মানুষ বসতে পারবে। এ ধরনের একটি থিয়েটার নির্মাণ করতে সাকল্যে সাড়ে চার কোটি থেকে পাঁচ কোটি টাকা খরচ হয় বলে জানান ঢাকার উত্তরার একটি বেসরকারি বিনোদনকেন্দ্রের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, একই আকৃতির থিয়েটার কেউ যদি ইউরোপের স্ট্যান্ডার্ডে নির্মাণ করেন, তাহলে সর্বোচ্চ ২০ কোটি টাকা খরচ হবে।
এই প্রকল্পের অন্য রাইডগুলোর মধ্যে ‘ডিসকো মেগার’ দাম ধরা হয়েছে ২৭ কোটি ৪২ লাখ টাকা। এই রাইড মূলত নৌকা আকৃতির কাঠামো, ভেতরে ৪০ জন বসতে পারে। রাইডটি দুলতে থাকে। এ ছাড়া ‘সুপার এয়ার রেসের’ দর ধরা হয়েছে ৪৯ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। এটি দেখতে কিছুটা নাগরদোলার মতো। আশুলিয়া ও নরসিংদীর দুটি বিনোদনকেন্দ্রের কর্মকর্তারা বলছেন, সর্বোচ্চ ভালো মানের হলেও রাইড দুটির দাম ২০ কোটি টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। তবে সিটি করপোরেশন রাইড দুটি কিনতে চাচ্ছে ৭৭ কোটি টাকায়।
এমনকি সিটি করপোরেশনের এই প্রকল্পে একটি জিপ গাড়ি (এসইউভি বা স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেহিকেল) ও একটি পিকআপ কেনার জন্য ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। পার্কের আধুনিকীকরণে এই গাড়ি কী কাজে লাগবে, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
সাধারণত দক্ষিণ সিটির বিভিন্ন প্রকল্পের ক্ষেত্রে দেখা যায়, অনুমোদন হওয়ার পর কাজ শুরু হতে বেশ দেরি হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেড় বছরও সময় লাগে। কিন্তু এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে। তাপসের পছন্দের পাঁচজন ঠিকাদারকে কাজটি ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। প্রকল্প পাস হওয়ার পর দ্রুতই ৫৫ লাখ টাকা ছাড় করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে ১০০ কোটি টাকা ছাড় করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
শিশুপার্কের আধুনিকীকরণের নামে অস্বাভাবিক দাম দেখিয়ে রাইড কেনার প্রকল্প শিগগিরই বন্ধ হওয়া উচিত বলে মনে করেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, রাইডগুলোর দর নতুন করে যাচাই-বাছাই করতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারমূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নতুন দর ঠিক করতে হবে।
৭৮ কোটি টাকায় যে কাজ করা যেত, সেই কাজ ৬০৪ কোটি টাকায় করা আসলে লুটপাটের আয়োজন বলে উল্লেখ করেন ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, সাবেক মেয়র তাপসসহ যাঁরা লুটপাটের এ আয়োজনে সহায়তা করেছেন, তাঁদের সবাইকে চিহ্নিত করতে তদন্ত হওয়া উচিত।
শাহবাগের শহীদ জিয়া শিশুপার্কের আধুনিকীকরণে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনকে ৭৮ কোটি টাকার প্রস্তাব মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় দিয়েছিল ভিন্ন একটি কারণে। শিশুপার্কটির মালিকানা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের। পার্কের একটি অংশসহ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ‘স্বাধীনতাস্তম্ভ নির্মাণ (তৃতীয় পর্যায়) প্রকল্প’ বাস্তবায়ন করছে। প্রকল্পের কাজের জন্য ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাস থেকে শাহবাগ শিশুপার্ক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় অন্যান্য কাজের পাশাপাশি শিশুপার্কের ভেতর দিয়ে ভূগর্ভস্থ পার্কিং নির্মাণের বিষয়টিও রয়েছে। এ কাজের জন্য পার্কের অনেক রাইড (খেলা ও বিনোদনের সরঞ্জাম) খুলে ফেলতে হয়েছে। এছাড়া প্রকল্পের কাজ চলার সময় শিশুপার্কের বিভিন্ন স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
যার কারণে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় মূলত ক্ষতিপূরণ হিসেবে সিটি করপোরেশনকে ওই প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব গ্রহণ করলে প্রকল্প তৈরি করে ‘ইচ্ছেমতো খরচ’ করার সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে, সেই বিবেচনায় সিটি করপোরেশন ওই প্রস্তাব গ্রহণ করেনি।
সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, তাপস এবং কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার আগ্রহে তিন বছরের প্রকল্পটি (জুলাই ২০২৩ থেকে জুন ২০২৬) চালু করা হয়। দ্রুততার সঙ্গে একনেকে পাস করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর (৫ আগস্ট) প্রকল্পের কাজ থমকে গেছে। অন্যথায়, এখন পর্যন্ত প্রকল্পের জন্য চলতি অর্থবছরে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ পাওয়ার কথা ছিল।
শহীদ জিয়া শিশুপার্কের আধুনিকীকরণের নামে অস্বাভাবিক ব্যয়ের বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, প্রকল্পে কোনো অস্বাভাবিক ব্যয় হলে তাতে অবশ্যই তদন্ত করা হবে। তাদের মূল লক্ষ্য হলো, দ্রুত পার্কটি খুলে দেওয়া, যাতে জনসাধারণ সুবিধা ভোগ করতে পারে।