ডেস্ক রিপোর্ট ।।
আর মাত্র এক রান দরকার। লর্ডস গ্যালারি উত্তেজনায় টানটান, হাজারো দক্ষিণ আফ্রিকান সমর্থক দাঁড়িয়ে। ব্যালকনিতে উঠেছেন সবাই, কেবল একজন তখনো বসে—টেম্বা বাভুমা। গালে হাত, চোখ মাঠে। যেন বুঝে গেছেন, জীবনভর যে স্বপ্নটা দেখে এসেছেন, সেই মুহূর্তটা এসে গেছে।
মিচেল স্টার্কের ফুলটস বলটা কাইল ভেরেইনার ব্যাটে লেগে ফাঁকা জায়গায় ছুটতেই বিস্ফোরণ ঘটে চারপাশে। উল্লাস, কান্না, আলিঙ্গন—সবকিছুর মাঝেও মাথা নিচু করে ফেলেন বাভুমা। যেন সমস্ত জর্জরতা, ‘চোকার্স’ অপবাদ, নেতৃত্ব নিয়ে নিঃশব্দ সংশয়—সব চাপা পড়ে যায় সেই নত মাথার আড়ালে।
এরপর যখন মাথা তোলেন, তখন তিনি আর কেবল এক ক্রিকেটার নন—একটি সময়ের প্রতিনিধি, একটি সমাজের আশা, একটি দলের উত্তরাধিকার।
বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ২০২৩–২৫ সাইকেলে দক্ষিণ আফ্রিকা ঘরের মাঠে ৬ ম্যাচে ৫টি জিতে অনবদ্য রেকর্ড গড়েছে। শুধু কেপটাউনে ভারতের বিপক্ষে একটি হার ছিল, সেটি ইতিহাসের সবচেয়ে ছোট টেস্ট—মাত্র দুই দিনে শেষ। শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ করেছে, ৫.০ জয়-পরাজয়ের অনুপাত ঘরের মাঠে সেরা।
ঘরের বাইরে তারা তিন সিরিজের দুটি জিতেছে, যার মধ্যে ছিল বাংলাদেশকে হারিয়ে এক দশক পর এশিয়ায় প্রথম সিরিজ জয়। বাইরের মাঠে তাদের জয়-পরাজয়ের অনুপাত ছিল ১.৫০—অস্ট্রেলিয়ার পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
সবচেয়ে অবিশ্বাস্য ছিল টানা আট টেস্ট জয়ের ধারা, যা WTC ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে দীর্ঘ। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ড্রসহ এটি ৯ ম্যাচের অপরাজিত ধারা—যেটি সমান রেকর্ড।
২০২৩ সালে যখন বাভুমা অধিনায়ক হন, তখন অনেকে প্রশ্ন তুলেছিলেন—তিনি কি শুধুই ‘কোটার অধিনায়ক’? অথচ এখন তিনিই বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন দলের নেতা। তাঁর নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকা ১০ টেস্টে ৯টি জয় পেয়েছে—ইংল্যান্ডের পার্সি চ্যাপম্যানের সঙ্গে যৌথভাবে রেকর্ড।
ব্যাট হাতেও কম যাননি। ১৩ ইনিংসে ৭১১ রান, গড় ৫৯.৩০—যা অন্তত পাঁচ ইনিংস খেলা ১৫৩ ব্যাটারের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। শেষ পাঁচ টেস্টে করেছেন ছয়টি পঞ্চাশোর্ধ্ব ইনিংস।
বাভুমার গড় পার্টনারশিপ ছিল ৬০.৩৫ রান—যা এই চক্রে সবচেয়ে বেশি।
দক্ষিণ আফ্রিকার পেসাররা গড় ২৩.৭৫ এবং স্ট্রাইক রেট ৪১.৯—উভয় ক্ষেত্রেই সেরা। রাবাদা ১১ টেস্টে ৫৬ উইকেট নিয়ে ছিলেন ত্রাস, গড় ১৮.৭৩।
দলের ১৫ জন ক্রিকেটার সেঞ্চুরি অথবা চার উইকেট নিয়েছেন, যার ৯ জন ছিলেন ফাইনালে। ৯ জন আলাদা খেলোয়াড় হয়েছেন ম্যাচসেরা—সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় ও দলকেন্দ্রিক অবদান।
বাভুমার গল্পটা শুরু হয় ছোটবেলায়—নিউল্যান্ডসের এসএসি জুনিয়র স্কুলে একটি রচনায় লিখেছিলেন, ‘১৫ বছর পর নিজেকে দক্ষিণ আফ্রিকার জার্সি পরে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে করমর্দন করতে দেখি।’ ২০২৫ সালের সেই ছবির অপেক্ষায় আজ গোটা জাতি। প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা ইতিমধ্যে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছেন, “এই জয় তোমার, এই জয় জাতির।”
বাভুমা প্রমাণ করেছেন—একজন কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান শুধু জাতীয় দলে জায়গা পেতে পারেন না, নেতৃত্ব দিয়ে বিশ্ব জেতাতেও পারেন। তাঁর নেতৃত্বে জয় এসেছে, নীরবতার মধ্যে উচ্চারিত হয়েছে সাহস আর বিশ্বাসের বাণী।