জুননু রাইন ।।
গত কয়দিন ড.আবদুল মোমেনের দুর্নীতি নিয়ে সোসাল মিডিয়ায় যে হারে সমালোচনা হচ্ছে সেই পরিমাণ সমালোচনা কিন্তু আওয়ামীলীগ আমলে যখন তাকে চাকরিচ্যুত করা হয় তখনও হয়নি। মানে, যে আ. লীগ ক্ষমতায় আসার সাথে সাথেই ড. মোমেনকে চাকরিচ্যুত করেছে তারা এবং তাদেরকে পোষ্য মিডিয়া স/ন্ত্রা/সী/রাও কিন্তু এমন উঠেপড়ে লাগেনি…
… আজকে ওনার এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তিনিও একজন শক্তিমান লেখক। তো উনি খুব আফসোস করে বললেন, ‘দেখো মোমেনের মতো সৎ মেধাবী অফিসারকে নিয়ে কি কি ছড়ানো হচ্ছে…, ও যে জীবন যাপন করেছে তা আমরা কোনোদিনও পারতাম না। ওর মতো গরিবানা জীবন তুমিও যাপন করতে পারতে না।’
এই আবদুল মোমেন হচ্ছেন লেখক আন্দালিব রাশদী। যার “প্রতিমন্ত্রী” এবং “ভারপ্রাপ্ত সচিব” নামে গুরুত্বপূর্ণ দুটো উপন্যাস আছে। তার যেকোনো লেখা পড়ে সময় নষ্ট হয়েছে বা ভালো লাগেনি বলবে- এমন পাঠক পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। আন্দালিব রাশদী তার লেখক নাম হলেও তিনি আরও কয়েকটি নামে লিখতেন। কেন লিখতেন জানেন? টাকার জন্য…
দুই হাতে লিখতেন। যে বিষয়ে মোমেন ভাই’র কাছে লেখা চাইতাম সে বিষয়েই তিনি লিখতে পারতেন। শুধু পারতেন’ই না, বরং ওই বিষয়ে অন্য যে কারোর চাইতে ভালো লিখতেন তিনি। মোমেন ভাই’র লেখা ছাপার ক্ষেত্রে এক ধরনের অদৃশ্য নিষেধাজ্ঞার মত নিরুৎসাহ থাকতো… তা কেন তখন বুঝতাম। কিছু করার ছিল না। নানা কৌশলে ছাপতে হতো। তবে ওনার অপরিচিত নামগুলোর জন্য উনি লিখে উপার্জন করার পথটা খোলা রাখতে পেরেছিলেন।
লেখালেখিটি যে ওনার আয় রোজগারের প্রধান উৎস এটা প্রথমে বুঝতে পারিনি। লেখার বিল চাইলে প্রথম প্রথম মনে করতাম- লিখে টাকা পাওয়ার আনন্দের জন্যই হয়তো বিল চাইছেন। কিন্তু না, ওনার টাকাটা খুব দরকারে আসতো…
উনি যুগান্তরে আসলে সম্পাদকের কাছে নিয়ে যেতে চাইতাম। বলতেন, তোমার সাথে আমার কাজ, তোমার পাতায় লিখি, তুমিই আমার সম্পাদকহতো। আমার সঙ্গে মাঝে মধ্যে যুগান্তর ক্যান্টিনে দুপুরের খাবার খেতেন। উনি বড় ভাই দাবী করে জোর করে বিল দিতেন। উনার একটা সঠিক ধারনা ছিল যে, উনি গরিব হলেও আমার চাইতে কিছুটা কম গরিব। তো একদিন জোর করে আমি বিল দিয়েছিলাম। এরপর থেকে দুপুরের খাবারের অফার করলে বলতেন, তুমি বিল দিলে খাবো না… এবং খেতেন’ই না।
অফিস থেকে নিচে নেমে রাস্তার চায়ের দোকানে আমরা চা খেতাম। বলতাম, চলেন যমুনা ফিউচার পার্কে কফি খাই। উনি বলতেন, ওটা বড় লোকের জায়গা। আমার রাস্তার পাশের চা’ই ভালো। দুষ্টামি করে বলতাম, আপনার বিল দিতে হবে না। আমি দেবো, চলেন। তখন হেসে হেসে বলতেন, আমারে এ্যাতো গরিব মনে করো না। আমার বিরুদ্ধে হাজার কোটি টাকার মামলা আছে…
মোমেন ভাই’র সাথে পরিচয় সম্ভবত ২০০৭/৮ সালে। দৈনিক ইত্তেফাকে। প্রথম পরিচয়েই এমনভাবে গল্প জুড়ে দিয়েছিলেন মনে হয়েছে ২০ বছর আগ থেকেই আমরা একসাথে আড্ডা দিই, আমরা কাছাকাছি বয়সের ভাই, বন্ধু…, মোমেন ভাই টিকাটুলির রোডের ইত্তেফাকের অফিসে আসলে দেশবন্ধু হোটেলে আমরা রুটি-ভাজি খেতাম। ১০/১৫ টাকায় নাস্তা হয়ে যেত। তারপর গলির মধ্যে একটা চায়ের দোকানে বসতাম। ছোট্ট দোকান। দেকানের পেছন থেকে উপরের দিকে হালকা পাতলা ২/৩টা ডাল ওয়ালা রুগ্ন একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ। দোকান এ্যাতো ছোট যে দোকানের চাইতে দোকানে বসে থাকা দোকানীকে বড় মনে হতো দোকানের সামনের বেঞ্চিতে বড়জোড় দুইজন বসা যেতো। মোমেন ভাইকে সম্ভবত ২টা প্যান্ট ২টা শার্টেই দেখেছি গত একযুগ ধরে। তাও খুব ম্লান। রোদে পোড়া। উনি যে মানের খাবার দোকানে বসে খাবার খেতে পারতেন সেই মানের দোকানে তথাকথিত রুচিসম্মত নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেনীর কেউ বসতে স্বাচ্ছন্নবোধ করবে না আমি নিশ্চিত। আমি অন্তত বসি না। আমার এলিটিটিতে লাগতো, লাগে এখনো
যদিও মোমেন ভাই গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুল, নটরডেম কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। আলাদাভাবে Economics-এ মাস্টার্স করেছেন University of Wales, UK থেকে। এবং পিএইচডি করেছেন School of Surveying, University of East London, UK থেকে। বাবা সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। তার এক মন্ত্রী মামার কিছু দুর্নীতি নিয়ে হালকা ঠাট্টাচ্ছলে সমালোচনা করতেও শুনেছি দুই এক সময়ে। তার এক ভাই ডাক্তার। বোন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। আমি উনার মা ভাই এবং বোনকে দেখেছি। সবাইকে মাটির মানুষ মনে হয়েছে…। কেমন ফসলি জমির মাটির ধুলো মাখা শরীর। শরীরে প্রিয় কবরের গন্ধ। এলিটিটির ছায়া ছোঁয়া বা গন্ধও নেই…
রিকশাওলারা যে দোকানে বসে দুপুরের খাবার খায় সেখানে বসে তিনি কেন অনায়াসে খেতে পারেন? তাহলে কেনই বা এ্যাতো এ্যাতো টাকার দুর্নীতি করেছেন, টাকাগুলো কী করেছেন
সরকারি চাকরি চলে যাওয়ার পরে মোমেন ভাই যে প্রতিষ্ঠানেই যোগ দিয়েছিলেন, সেখান থেকেই তাকে বের করে দিতে প্রতিষ্ঠানকে সরকার চাপ প্রয়োগ করতো। এরকম তিনটি প্রতিষ্ঠান থেকে সরকার তাকে বের করে দেয়। বেচারা আর চাকরি না পেয়ে বা না করে লেখালেখিকেই পেশা এবং আয়ের মূল উৎস হিসেবে বেছে নিলেন। গত ১৬ বছর ধরে তার প্রধান কাজ হলো লেখালেখি করা, পত্রিকা অফিসে আসা যাওয়া করা আর বিভিন্ন সরকারি তদন্ত সংস্থায় জবাবদিহি করা… এইসব পাহাড়সম চাপ থাকা সত্যেও তিনি সবসময় হাসিখুশি থাকতেন। কেমন আছেন জিজ্ঞেস করলেই হেসে হেসে বলতেন, ভালো থাকার নির্দেশ আছে
তো, ভালো থাকবেন মোমেন ভাই। চুরি করতে না পারা, বাটপারি করতে না জানা, এলিট হতে না পারা সাধারণ মানুষের নির্দেশ আছে, আপনি ভালো থাকবেন মোমেন ভাই
ফেসবুকে জুননু রাইনের পাবলিক পোস্ট