স্টাফ রিপোর্টার ।।
ঘোষিত প্রার্থী তালিকা ঘিরে বিএনপির ভেতরে তীব্র অসন্তোষ চরম আকার নিয়েছে। রিভিউয়ের দাবি উঠেছে আসনজুড়ে। সারা দেশে একের পর এক মানববন্ধন, সড়ক অবরোধ, মশালমিছিল, বিক্ষোভ এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় বিস্তর ক্ষোভ প্রকাশ পাওয়া যাচ্ছে। দলের দায়িত্বশীলরা বলছেন, কমপক্ষে ৪০টির বেশি আসনে মনোনয়ন নিয়ে দ্বন্দ্ব এমন পর্যায়ে গেছে, যেখানে জেলা–উপজেলার সাংগঠনিক ঐক্য ভেঙে পড়ার মত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
গতকাল শনিবারও আটটি আসনে বিক্ষোভ হয়েছে। মনোনয়ন–বঞ্চিত অনেক প্রভাবশালী নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কেন্দ্রীয় নেতারা পরিস্থিতি সামাল দিতে একে একে নেতাদের ঢাকায় ডেকে বুঝিয়ে বলছেন; কোথাও কোথাও প্রার্থী পুনর্বিবেচনার কথাও উঠেছে।
স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলছেন—
“বড় দলে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘটনা থাকেই; আলাপ–আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করাই আমাদের লক্ষ্য।”
নাটোর–১ আসনে প্রয়াত সাংসদ ফজলুর রহমান পটলের মেয়ে ফারজানা শারমিন (পুতুল) মনোনয়ন পাওয়ার পরই পরিস্থিতি বিস্ফোরক হয়ে ওঠে।
- ক্ষুব্ধ হন সহদপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম
- বিক্ষোভ করেন পুতুলের ভাই ইয়াছির আরশাদ
- শহরে মিছিল, ধাওয়া–পাল্টা ধাওয়া—পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়
পরে উভয় পক্ষকে গুলশানে ডেকে সতর্ক করেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল। কেন্দ্র জানায়, “সামান্য ভুল–বোঝাবুঝি”, তবে বাস্তবে স্থানীয় বিএনপি এখনো বিভক্ত।
রাজধানীতে অন্তত তিনটি আসনে তীব্র বিক্ষোভ দেখা গেছে।
- ঢাকা–১২ ও ঢাকা–১৫: প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে বহু নেতাকর্মী মানববন্ধন করেছেন।
- নারায়ণগঞ্জ–২ ও ৩: বিক্ষোভ, সড়ক অবরোধ, মশালমিছিল—সবই দেখা গেছে।
অনেকে অভিযোগ করেছেন, “জেলা নেতৃত্বের মতামত না নিয়েই কেন্দ্রীয়ভাবে প্রার্থী চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।”
কুমিল্লা বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে দুই ভাগে বিভক্ত—মনোনয়নে সেই দ্বন্দ্ব আবারও মাথাচাড়া দিয়েছে।
- কুমিল্লা–৬: মনিরুল হকের বদলে আমিন–উর–রশিদকে মনোনয়ন দেওয়ায় বিক্ষোভ
- কুমিল্লা–৯: পুরোনো দ্বন্দ্ব ফের জেগে উঠেছে; তারেক রহমানের সরাসরি হস্তক্ষেপে সামিরা আজিমকে সংরক্ষিত আসনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আপাতত শান্ত করা হয়েছে
স্থানীয় নেতারা বলছেন, “এভাবে হলে নির্বাচনের মাঠে কাজ করা কঠিন হবে।”
ফেনী–২–এ মনোনয়ন না পেয়ে জেলা বিএনপির সদস্যসচিব আলাল উদ্দিন ধানক্ষেতে দাঁড়িয়ে ক্রিকেটারের স্টাইলে ‘রিভিউ আবেদন’ করার ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।
পরে আরও ছয়জন নেতা লিখিতভাবে মনোনয়ন পুনর্বিবেচনার আবেদন জমা দেন।
কেন্দ্রে বেগ পেয়ে একজন নেতা মন্তব্য করেন—
“যদি মাঠেই সিদ্ধান্ত হয়, তাহলে মনোনয়ন কেন ঢাকা থেকে দিতে হবে?”
এ আসনে কামাল জামান মোল্লাকে মনোনয়ন দেওয়া হলে তাৎক্ষণিক বিক্ষোভ হয়।
জেলা থেকে জানানো হয়—
- স্থানীয়ভাবে লাভলু সিদ্দিকী শক্তিশালী প্রার্থী
- কেন্দ্র থেকে কামাল জামান মনোনয়ন, যা জেলা কমিটিতে তীব্র অসন্তোষ তৈরি করে
অবশেষে কেন্দ্র মনোনয়ন স্থগিত করে দুজনের ব্যাপারে নতুন করে যাচাই–বাছাই শুরু করেছে।
এই আসনে ঘোষিত প্রার্থীকে প্রত্যাহারের দাবিতে সীতাকুণ্ডে মহাসড়ক চার ঘণ্টা অবরোধ করা হয়।
এ ঘটনায় কয়েকজন নেতাকে পরে দল থেকে বহিষ্কৃত করা হয়।
চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপি বলছে—
“যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাতে সংগঠন দুর্বল হচ্ছে।”
সিলেট অঞ্চলের বেশ কিছু আসনে জোটগত, প্রবাসী এবং স্থানীয় নেতাদের টানাপোড়েনে মনোনয়ন বিতর্ক তীব্র হয়েছে।
- সুনামগঞ্জ–১, ৩ ও ৫: সড়ক অবরোধ, মিছিল, মানববন্ধন
- সিলেট–৩: যুক্তরাজ্য বিএনপি নেতা এম এ মালিকের মনোনয়নকে কেন্দ্র করে ফেসবুক উত্তপ্ত
স্থানীয় নেতাদের প্রশ্ন—
“প্রবাসী নেতাকে কীভাবে তৃণমূলের চেয়ে বেশি পছন্দ করা হলো?”
উত্তরাঞ্চলে পরিস্থিতি সবচেয়ে বেশি জটিল বলে জানা গেছে।
কোথাও দলীয় কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে, কোথাও প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে সড়ক অবরোধ।
কুষ্টিয়া–২, ৩ ও ৪—এই তিনটি আসনেই মশালমিছিল হয়েছে।
প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে দুই জেলায়ই নেতাকর্মীরা কাফনের কাপড় পরে মিছিল করেছেন।
দিনাজপুরে প্রতীকী ফাঁসির মঞ্চ বানিয়ে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়।
- মনোনয়নবঞ্চিতদের লাইভ ভিডিও
- জেলা–উপজেলায় নেতাদের আবেগী পোস্ট
- “স্বতন্ত্র হিসেবে লড়ব”—এমন ঘোষণা
- বিভিন্ন জায়গায় প্রার্থীকে নিয়ে মিম, ব্যঙ্গচিত্র
ভোটাররাও মন্তব্য করছেন,
“নিজেদের দলীয় বিভাজন সামলাতে না পারলে নির্বাচনে তারা কীভাবে লড়বে?”
মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেছেন—
“আমরা প্রত্যেক এলাকায় কথা বলছি। যেখানে সমস্যা আছে, সেখানে সমাধানের চেষ্টা চলছে।”
কেন্দ্রীয় নেতাদের মতে—
- জরিপ রিপোর্ট গুরুত্বপূর্ণ
- জনপ্রিয়তা–সংগঠন–জোটের সমীকরণ মিলিয়েই সিদ্ধান্ত
- প্রয়োজন হলে কিছু প্রার্থী পুনর্বিবেচনা হতে পারে
বাংলাদেশের বড় দুই দল—আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—দুটি দলেই মনোনয়ন নিয়ে ক্ষোভ সাধারণ ঘটনা। তবে এবার বিএনপিতে অসন্তোষের মাত্রা ও বিস্তার অনেক বেশি।
মূল কারণগুলো—
- তৃণমূলের সঙ্গে যোগাযোগে বিচ্ছিন্নতা
- কেন্দ্রীয়–স্থানীয় দ্বন্দ্ব
- প্রবাসী বা কেন্দ্র–ঘনিষ্ঠ নেতাদের অগ্রাধিকার
- বহু আসনে দলীয় বিভাজন পুরোনো
সিনিয়র নেতারা মনে করেন, “ক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে না আনলে নির্বাচন মাঠে সাংগঠনিক কাঠামো দুর্বল থাকতে পারে।”