সৈয়দ হাসসান ।।
বায়তুল মোকাররমের নবনিযুক্ত খতিব আল্লামা মুফতি আব্দুল মালেক বাংলাদেশের ইসলামি জ্ঞানের ক্ষেত্রে এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। তিনি দেশ-বিদেশে ফিকাহ ও হাদিসশাস্ত্রে বিশেষজ্ঞ হিসেবে সুপরিচিত, এবং তার জ্ঞান ও গবেষণার জন্য আলেম সমাজে বিশেষ মর্যাদা অর্জন করেছেন। আলেমদের কাছে তিনি একজন নির্ভরযোগ্য ইলমি ব্যক্তিত্ব, যার মতামত ও গবেষণাকে সব সময়ই সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করা হয়।
আব্দুল মালেক ১৯৬৯ সালের ২৯ আগস্ট বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার লাকসাম উপজেলার সারাশপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। তার বাবা মাওলানা শামসুল হক (রহ.) ছিলেন ওই অঞ্চলের একজন খ্যাতিমান আলেম। ছোটবেলা থেকেই ইসলামি পরিবেশে বড় হওয়া মাওলানা আব্দুল মালেক পরিবারে কোরআন মাজিদ ও প্রাথমিক শিক্ষালাভের পর চাঁদপুরের শাহরাস্তির খেড়িহর কওমি মাদ্রাসায় মিশকাত জামাত পর্যন্ত পড়াশোনা করেন।
১৯৮৮ সালে আল্লামা আব্দুল মালেক পাকিস্তানের বিখ্যাত জামিয়া উলুমুল ইসলামিয়ায় দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি তিন বছর ধরে ওই মাদ্রাসার উচ্চতর হাদিস বিভাগে অধ্যয়ন করেন, যেখানে তার শিক্ষক ছিলেন বিখ্যাত আলেম মাওলানা আব্দুর রশীদ নোমানী (রহ.)। ১৯৯২ সালে তিনি দারুল উলুম করাচিতে মুফতি তাকি উসমানির তত্ত্বাবধানে উচ্চতর ফিকাহ ও ফতোয়া বিষয়ে পড়াশোনা করেন।
পরবর্তীতে তিনি সৌদি আরবে যান এবং সেখানে আরব বিশ্বের অন্যতম প্রখ্যাত আলেম শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহর তত্ত্বাবধানে প্রায় আড়াই বছর ধরে হাদিসশাস্ত্রসহ অন্যান্য গবেষণামূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এই সময়ে তিনি ইসলামের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শাস্ত্রের গভীর গবেষণা করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।
১৯৯৬ সালে আল্লামা আব্দুল মালেক ও তার বড় ভাই মাওলানা আবুল হাসান আব্দুল্লাহ ঢাকায় উচ্চতর ইসলামি শিক্ষা ও গবেষণার জন্য মারকাযুদ দাওয়াহ আল ইসলামিয়া প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রতিষ্ঠানটি মূলত তার নেতৃত্বেই বিশেষ পরিচিতি লাভ করে এবং বর্তমানে এটি দেশের অন্যতম প্রধান ইসলামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিগণিত। পল্লবী ও কেরানীগঞ্জে এর দুটি ক্যাম্পাস রয়েছে। এখানে তিনি ইলমি গবেষণার পাশাপাশি ছাত্রদের উচ্চতর শিক্ষা প্রদান করেন। তার তত্ত্বাবধানে বহু ছাত্র আজ দ্বীনের খেদমতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন।
আল্লামা আব্দুল মালেক মারকাযুদ দাওয়াহ আল ইসলামিয়ার পাশাপাশি ঢাকার জামিয়াতুল উলুমিল ইসলামিয়ার শায়খুল হাদিস এবং শান্তিনগরের আজরুন কারিম জামে মসজিদের খতিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। কওমি মাদ্রাসার সরকারি স্বীকৃতির জন্য গঠিত বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কমিশনের সদস্য হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের জাতীয় চাঁদ দেখা উপকমিটির প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন। এছাড়া তিনি বিভিন্ন ইলমি ও দ্বীনি কাজে সম্মিলিতভাবে আলেমদের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন।
২০০৫ সালে মারকাযুদ দাওয়াহ আল ইসলামিয়ার মুখপত্র হিসেবে আল্লামা আব্দুল মালেকের তত্ত্বাবধানে মাসিক “আল-কাউসার” প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকায় সমসাময়িক বিভিন্ন ইলমি বিষয়ে তার গবেষণামূলক রচনা নিয়মিত প্রকাশিত হয়। তার রচনাগুলো ইসলামি শিক্ষার ক্ষেত্রে দেশজুড়ে আলেম ও সাধারণ পাঠকদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়।
আব্দুল মালেকের প্রকাশিত গ্রন্থসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
- তালিবুল ইলমের পথ ও পাথেয়
- উম্মাহর ঐক্য: পথ ও পন্থা
- প্রচলিত ভুল
- হাদিস ও সুন্নায় নামাজের পদ্ধতি
- ইমান সবার আগে
- প্রচলিত জাল হাদিস
এর পাশাপাশি আরবি ভাষায় তার রচিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে “আল-মাদখাল ইলা উলুমিল হাদিসিশ শরিফ”, “আল-ওয়াজিজ ফি শাইয়ি মিন মুসত্বলাহিল হাদিসিশ শরিফ”, এবং “মুহাদিরাত ফি উলুমিল হাদিস”।
আল্লামা আব্দুল মালেকের ইলমি ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে প্রশংসা করেছেন অনেক খ্যাতিমান আলেম। মদিনার বিখ্যাত মুহাদ্দিস শায়খ আওয়ামা তাকে “মুহাক্কিক আলেম” হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ (রহ.) তার সম্পর্কে বলেন, “মাওলানা আব্দুল মালেক তার উস্তাদদের থেকেও অনেক এগিয়ে যাবেন।”
আল্লামা আব্দুল মালেকের ব্যক্তিগত জীবন অত্যন্ত সাদাসিধে। তিনি সব সময় জ্ঞানচর্চা এবং ইলমি কাজে নিমগ্ন থাকেন। তিনি কেরানীগঞ্জের হজরতপুরে মারকাযুদ দাওয়াহ ক্যাম্পাসে বেশি সময় কাটান এবং ছাত্রদের উচ্চতর ইলমি গবেষণায় উৎসাহিত করেন। সময়ের ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত সতর্ক এবং জীবনযাপনে সুনিয়ন্ত্রিত।
আল্লামা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক বাংলাদেশ এবং আন্তর্জাতিক ইসলামি অঙ্গনে একজন বরেণ্য ব্যক্তিত্ব। তার গবেষণা ও জ্ঞানচর্চা বাংলাদেশের আলেম সমাজে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে এবং তার অবদান বাংলাদেশের জন্য বড় এক সম্পদ হিসেবে বিবেচিত।