জাফর সাদিক ।।
এই সামন্ত লাল বার্ন ইউনিটের হেফাইস্টাস বা ভালকানে পরিণত হন মূলত ২০১৪–১৫ সালের দিকে, যখন ইনু ও হাসিনা গং বিএনপির অবরোধে সংঘটিত নাশকতাসমূহকে বিএনপি–জামায়াতের ‘অগ্নিসন্ত্রাস’ বলে অভিহিত করে।
তখন ঢাকা মেডিকেলে বার্ন ইউনিট ছিল, যেখানে আগুনে পোড়া রোগীরা চিকিৎসা নিতেন। সেসময় বাসে আগুনে হতাহতদের সেখানেই নিয়ে আসা শুরু হলে, সামন্ত লাল হুট করেই দগ্ধ রোগীদের অবস্থা ও সংখ্যা বিষয়ে ব্রিফিংয়ের একচ্ছত্র ঠিকাদারির ভূমিকায় হাজির হন। তার অনুমতি ছাড়া তখন কেউ কথা বলতে পারত না।
সেই সময় ফিল্ড জার্নালিজমের সুবাদে ঘন ঘন বার্ন ইউনিটে যেতে হতো। ২০১৪–১৫ সালে সম্ভবত যাত্রাবাড়িতে গ্লোরি পরিবহনের একটি বাসে রাত ১১টা বা ১২টার দিকে আগুন দেওয়া হলে অন্তত ৩০–৩২ জন দগ্ধ হন, বেশ কয়েকজন নিহত হন। এটাই সেই ঘটনা, যে মামলায় খালেদা জিয়াকে আসামি করে দীর্ঘদিন হয়রানি করা হয়েছে।
সেদিন রাতে ডিউটি থাকায় বার্ন ইউনিটে ছুটে গেলে সেখানে চামড়া ঝলসানো একের পর এক রোগীর দৌড়ে আসার দৃশ্য দেখে নিজেরই কষ্ট আর যন্ত্রণায় বমি চলে আসার উপক্রম হয়। এর মাঝেই কয়েকজন দগ্ধের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, বাসটিতে একজন যুবক আগুন লাগিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় মাত্র ১০০ গজ দূরত্বে পুলিশ দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু তাকে আটকানোর কোনো চেষ্টাই তারা করেনি! এ নিয়ে ভক্সপপও নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু অন–এয়ারের মতো পরিবেশ তখন ছিল না।
অথচ পরদিন যখন ব্রিফিং হয়, তখন সামন্ত লালরা চিকিৎসা নিয়ে কথা বলার বাইরেও এমনভাবে ব্রিফ করতেন যেন আগুনের দায়টা সরাসরি বিএনপি–জামায়াতের ওপরে পড়ে!
এভাবেই টানা প্রায় ১০ বছর তিনি আগুনে পোড়া রোগী নিয়ে আওয়ামী বয়ান শক্তিশালীকরণে সচেষ্ট ছিলেন। যার ফলশ্রুতিতে পরবর্তীতে গোটা একটি বার্ন ইনস্টিটিউট করার সুযোগ পান। যার পুরো কেনাকাটা ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব হাসিনা এই লাল দাদুকেই দিয়েছিলেন! লাল দাদু সেই ইনস্টিটিউটের নামও তাই হাসিনার নামে রাখার প্রয়াস নিয়ে সফল হন। এরপর সর্বশেষ নির্বাচনে তিনি অবৈধ সরকারের মন্ত্রীও হন!
সামন্ত লাল ভালো না খারাপ ডাক্তার, তা নিয়ে আমার জানাশোনা নেই। তার ডিগ্রি বা অভিজ্ঞতা সম্পর্কেও জানি না। কিন্তু তিনি যে স্ট্যান্ডবাজিতে পারদর্শী ও অভিজ্ঞ, তাতে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। ২০২৪ সালে তিনি ভুটানের কারমা দেমা নামের একজনের নাকের অস্ত্রোপচার করে এমনভাবে প্রচারণা চালান, যেন তিনি একাই সব করে ফেলেছেন! অথচ এর সঙ্গে জড়িত অন্যান্য চিকিৎসকদের তিনি পুরোপুরি আড়াল করে দেন!
এভাবেই তাঁর অধীনে থাকা সকল চিকিৎসককে ছাপিয়ে তিনি একাই দেশসেরা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি বিশেষজ্ঞ সেজে বসেন! অথচ নিশ্চিতভাবেই তাঁর চেয়ে অনেক ভালো ডাক্তার এই দেশেই আছেন—এই বার্ন ইনস্টিটিউটেই আছেন! কিন্তু লাল দাদু একাই সব ক্রিম খেয়ে খেয়ে দেশের প্রথম অগ্নিদেবতা হেফাইস্টাসে পরিণত হন।
২০২৪ সালের নির্বাচনের আগেও লাল দাদু ‘তথাকথিত অগ্নিসন্ত্রাস’-এর বিরুদ্ধে শাহবাগে মানববন্ধনে দাঁড়ান, আগুনঝরা মানবিক বক্তব্য দেন। কিন্তু বিনাবিচারে গুম-খুন, মানুষ পুড়িয়ে মারার পেছনের রাজনীতি—এসব নিয়ে তার কখনো কোনো মাথাব্যথা ছিল না। তিনি শুধু আওয়ামী লীগের সুবিধা পাওয়া এবং দলকে সুবিধা দেওয়ার প্রচেষ্টায় মত্ত ছিলেন। নিজের নাম ফুটাতে ব্যস্ত ছিলেন। এর প্রতিদানস্বরূপ নির্বাচনের পরপরই টেকনোক্র্যাট কোটায় স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদ বাগিয়ে নেন।
তিনি হয়তো আওয়ামী লীগ ও তার স্যাঙ্গাতদের কাছে দেবতা হতে পারেন—but not to me।
দেবতার যারা পূজারি, তারা পূজা করুক—সমস্যা নেই।
কিন্তু ছোটদের ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস, গরিবের লেনিন–একজন অর্থনীতির শিক্ষক যখন তাকে আবার মাইলস্টোনের আহতদের চিকিৎসার দায়িত্ব দেওয়ার আহ্বান জানান, তখন বিষয়টা আর নিরেট মানবিক থাকে না—রাজনৈতিক হয়ে যায়।
স্যারকে বলছি—নিজেকে প্রাসঙ্গিক রাখার আরও অনেক উপায় আছে। দরকার হলে আরেকবার স্টেশন রেখে মাঝপথে ট্রেন থেকে লাফ দিয়ে নেমে দেখতে পারেন, ভাইরাল হবেনই নিশ্চিত! আপনার ‘গুণমুগ্ধ সাহাবি’রাও তখন আপনার কর্মকাণ্ডকে আবার ‘মহামানবের মানবিক দুর্বলতা’ বলে চালিয়ে দেবে—আপনার অমরত্ব নিশ্চিতে ঝাঁপিয়ে পড়বে।
কিন্তু দয়া করে, এই দুঃসময়ে বিতর্ক তৈরি করবেন না।
আপনার জানা না–ও থাকতে পারে, কিন্তু সামন্ত লালকে ছাড়াও বার্ন ইনস্টিটিউটের চিকিৎসা খুব ভালোভাবেই চলছে। আপনার পছন্দ না হলে লাল দাদুর সঙ্গে গলা মিলিয়ে আফসোস করুন—কেউ বাধা দেবে না। কিন্তু সংকটকালে হাসিনার ল্যাসপেন্সার আর সুবিধাভোগীদের পুনঃপ্রতিষ্ঠার রাজনীতি করবেন না—please.
বিতার্কিক ও সংবাদ উপস্থাপক জাফর সাদিকের ফেসবুক পোস্ট