স্টাফ রিপোর্টার ।।
দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে আধুনিক ও দৃষ্টিনন্দন ভবন, বিলাসী ক্যাম্পাস ও প্রযুক্তিনির্ভর অবকাঠামো গড়ে তোলার প্রতিযোগিতা তীব্র হয়েছে। মার্বেল পাথরের ফ্লোর, কাচের দেয়াল, এসকেলেটর, সুইমিং পুল, জিমনেসিয়াম, আন্তর্জাতিক মানের ল্যাব, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত শ্রেণিকক্ষ—সবই যেন এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরিহার্য অংশ। তবে এই অবকাঠামো নির্মাণের বিপুল ব্যয়ভার বহন করতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের, টিউশন ফির আকারে।
অনেক অভিভাবক বলছেন, অতিরিক্ত সাজসজ্জা ও অবকাঠামোর চাকচিক্যের কারণে ফি এত বেশি হয়ে গেছে যে নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের পক্ষে প্রথম সারির প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্তান ভর্তি করানো কঠিন হয়ে পড়েছে। একইসঙ্গে তাদের অভিযোগ, অবকাঠামো উন্নয়নের সঙ্গে শিক্ষার মান বাড়ছে না।
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে অনুমোদিত ১১০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১০৪টিতে বর্তমানে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। বর্তমানে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে প্রতি সেমিস্টারে টিউশন ফি ৫০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা; কয়েক বছর আগেও এই পরিমাণ ছিল ৩০-৮০ হাজার টাকা। বছরে গড়ে খরচ দাঁড়াচ্ছে ১.৫ লাখ থেকে ৪ লাখ টাকা। চার বছরের স্নাতক ডিগ্রির খরচ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় ১৫ থেকে ২৫ গুণ বেশি।

ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (ইউআইইউ): মাদানী অ্যাভিনিউয়ের পাশে ২৫ বিঘা জমিতে ক্যাম্পাস, ফুটবল মাঠ, ১২ তলাবিশিষ্ট একাডেমিক ভবন।
শুধু গত দুই বছরেই কয়েকটি শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয় ফি বাড়িয়েছে ২০-৪০ শতাংশ। নতুন ভবনের উদ্বোধনের পরপরই ফি বৃদ্ধির ধারা যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। অথচ শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, পাঠদানের মান বা একাডেমিক সেবার মানে বড় ধরনের উন্নতি ঘটেনি।
ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এসএমএ ফায়েজ বলেন, লাগামহীন ফি বৃদ্ধি এখন এক ধরনের ব্যবসায়ে পরিণত হয়েছে, যা শিক্ষার্থীদের জন্য বড় বোঝা। উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা জানিয়েছে—তারা স্থায়ী ক্যাম্পাস চায় না, কারণ এতে ফি আরও বাড়বে, যা বহন করা কষ্টকর। ইউজিসি আলোচনার মাধ্যমে একটি সীমা নির্ধারণের উদ্যোগ নিচ্ছে, যাতে নির্দিষ্ট সীমার পর আর ফি বাড়ানো না যায়।
রাজধানীতে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় আধুনিক অবকাঠামোর জন্য আলোচিত।
- ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি: মেরুল বাড্ডায় সাত একর জায়গায় নির্মিত, ব্যয়বহুল লোকেশন ও আন্তর্জাতিক মানের স্থাপত্য।
- ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (ইউআইইউ): মাদানী অ্যাভিনিউয়ের পাশে ২৫ বিঘা জমিতে ক্যাম্পাস, ফুটবল মাঠ, ১২ তলাবিশিষ্ট একাডেমিক ভবন।
- ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি: আফতাবনগরে ৭.৪ বিঘা জমিতে ৯ তলা ভবন, পাঁচ লাখ বর্গফুট একাডেমিক ও প্রশাসনিক স্থান।
ইউআইইউর এক শিক্ষার্থী বলেন, “ভালো অবকাঠামো দরকার, কিন্তু এর জন্য যদি ফি বাড়তেই থাকে, তাহলে উচ্চশিক্ষা কঠিন হয়ে যাবে।”
আরেকজন শিক্ষার্থী জানান, ২০২২-২৩ সালে প্রতি ক্রেডিট ৫,৫০০ টাকা থেকে বেড়ে ৬,৫০০ টাকা হয়েছে, অথচ সিলেবাস বা ফ্যাকাল্টির মানে পরিবর্তন আসেনি।
নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির এক শিক্ষার্থী বলেন, “ক্লাসরুমে প্রজেক্টর ঠিকভাবে চলে না, অথচ কোটি টাকা খরচ হয় মার্বেল বসাতে।”
ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী জানান, আন্তর্জাতিক মানের ক্যাম্পাসে পড়া গর্বের, তবে মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য প্রতিটি সেমিস্টার যেন যুদ্ধ।
বিইউবিটির এক শিক্ষার্থী বলেন, “প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় দানবের মতো—নতুন কিছু হলেই ফি বাড়ে। কিছু প্রতিষ্ঠানের ফি দুই বছরে ১০০ শতাংশ বেড়েছে।”

ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি: আফতাবনগরে ৭.৪ বিঘা জমিতে ৯ তলা ভবন, পাঁচ লাখ বর্গফুট একাডেমিক ও প্রশাসনিক স্থান।
ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীর বাবা হাফিজুর রহমান বলেন, “সেমিস্টার ফি ৫০ হাজার থেকে ৭৫ হাজার হয়েছে। বাড়িভাড়া, খাওয়া-দাওয়া, বই খরচ মিলিয়ে মাসে ৩০ হাজারের বেশি লাগে। জমি বিক্রি করছি যেন ছেলে গ্র্যাজুয়েট হয়।”
ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীর মা পারভীন নাহার বলেন, “নতুন ক্যাম্পাস হওয়ার পর ফি বেড়েছে, প্রজেক্ট খরচও বেশি। ব্যাংক ঋণ নিতে হয়েছে।”
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অবকাঠামো উন্নয়ন ফি, সার্ভিস চার্জ, ল্যাব ফি, আইটি ফি ইত্যাদি ‘হিডেন চার্জ’ হিসেবে নিচ্ছে, যা সেমিস্টারপ্রতি ১০-১৫ হাজার টাকা বাড়তি খরচ তৈরি করছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খান বলেন, “গবেষণা, শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও পাঠ্যক্রম হালনাগাদ শিক্ষার মূল উপাদান। শুধু ভবন নির্মাণ শিক্ষাকে বাহ্যিক রূপ দেয়, কিন্তু মান উন্নত করে না।”
অতিরিক্ত টিউশন ফি ও বাড়তি চার্জের কারণে অনেক শিক্ষার্থী ঋণগ্রস্ত বা মাঝপথে পড়াশোনা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন। শিক্ষাবিদদের মতে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিলাসী অবকাঠামোর প্রতিযোগিতা বাদ দিয়ে মানসম্মত শিক্ষা, গবেষণা সক্ষমতা ও সাশ্রয়ী ফি নিশ্চিত করার দিকে মনোযোগী হতে হবে—তবেই উচ্চশিক্ষা সবার জন্য সহজলভ্য হবে।