বুধবার, আগস্ট ৬, ২০২৫

হাঁটছি, চোখ বন্ধ করে হাঁটছি। কাঁদছি…

এতিম! তোমরা দুঃখ করো, ষড়যন্ত্র করো, গুজব ছড়াও। কিন্তু তোমাদের আপা আর ফিরবে না, এটা মেনে নাও।

by ঢাকাবার্তা
জাফর সাদিক

জাফর সাদিক ।। 

৫ আগস্ট ২০২৪। আগের রাতে চারটার দিকে ঘুমুতে গেলাম জোর করেই; কারণ সকালে লংমার্চে যেতেই হবে।

রাতেই ‘লংমার্চ পরশু নয়, আগামীকাল’- সেই ঐতিহাসিক ঘোষণা চলে এসেছে। সারারাত একটা থমথমে পরিবেশ। কি হয় কি হয় ভাব!

একদিকে বাসায় আমার স্ট্রোক করে বিছানায় বাক ও চলৎশক্তিহীন মা, অন্যদিকে ডাকছে দেশ। সব বাধা ছাপিয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত, লংমার্চে যাবোই। ব্যাস! শরীরে শক্তি জোগাতে ঘুমিয়ে পরলাম। ৮টার দিকে ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই টিভি ছাড়লাম। ঘৃণায় মুখে থু থু চলে আসলো। একে একে সব বাংলাদেশী চ্যানেল দেখলাম, কোথাও কিচ্ছু নেই! সব বাতাবি লেবুর ফলন, সরকারের ভাষ্য প্রচারে ব্যস্ত। কি সময়, কি যমুনা, কি এনটিভি, কি টোয়েন্টি ফোর!

টিভি অফ করে সব চুতিয়াদের উদ্দেশ্যে একটা অকথ্য গালি দিয়ে গোসলে ঢুকলাম৷ দীর্ঘ সময় নিয়ে ঝর্ণার পানিতে ভিজলাম, চোখের পানি আর কলের পানি এক হয়ে মিশে গেলো নিমিষেই।

সময় নিয়ে সবুজ একটা টিশার্ট বেছে নিলাম, যাতে বুকে গুলি খেলে আমার লাল রক্তে শরীরটা বাংলাদেশের পতাকা হয়ে উঠে। গায়ে প্রচুর সুগন্ধি মাখলাম। একজোড়া প্রায় বাতিল জুতা বেছে নিয়ে পরলাম। যাতে দৌড়াতে গিয়ে জুতার চিন্তা করতে না হয়। এক প্লেট ভাজা ভাত খেয়ে জায়ীমের কপালে একটা চুমু খেলাম, তিনতলায় নেমে সোজা আম্মার রুমে ঢুকে নিস্তব্ধ মায়ের কপালে একটা চুমু দিলাম। অজান্তেই বোধহয় একফোঁটা চোখের পানি মার কপালে পরলো, মা চোখটা খুলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ‘উ উ’ শব্দ করলেন। আস্তে করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে সোজা রাস্তায়।

প্রথমে প্ল্যান করলাম, শাহবাগের দিকে যেতে হবে যে কোনো উপায়ে। কল করলাম সাইমুম মৌসুমী বৃষ্টি কে, Prapti Taposhi কে। শুনলাম সায়েন্সল্যাব আর ধানমণ্ডির দিকে পুলিশের গুলিতে রাস্তায় দাঁড়ানোই যাচ্ছে না। খোঁজ নিলাম শাহবাগে, ওদিকেও কেউ ঢুকতেই পারছে না। এরপর সবশেষ ভাবলাম জাহাঙ্গীরনগর থেকে সকালে যে মিছিল আসার কথা গাবতলী গিয়ে ওটায় যুক্ত হবো। খোঁজ নিয়ে জানলাম, ওরা তখনো মিছিল বের করতে পারে নি। সাভার লীগের অস্ত্রধারী গুণ্ডা আর পোশাকধারী পুলিশলীগের দখলে। মিরপুর ১০ দিয়েও কাউকে যেতে দিচ্ছে গুণ্ডালীগ ও পুলিশলীগ।

কি করবো, কি করবো ভাবতে ভাবতে গেলাম পল্লবী থানার দিকে। রাস্তায় অল্প কিছু মানুষ চোখে উৎকন্ঠা নিয়ে ইতিউতি ঘুরছে। থানার ভেতরে পুলিশ বাংকার বানিয়ে মেশিনগান ফিট করে, কয়েক স্তরে অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে আছে। কোথাও কেউ নেই!

কল করলাম সহকর্মী Kamruzzaman Mamun কে। বললাম বের হবেন কিনা। তিনি জানালেন, খানিক পর বের হবেন। খানিকটা হতাশ। কোথাও কোনো মুভমেন্টের খবর পাচ্ছেন না। আমি কল কেটে একবার রাস্তার ওইপাশ, আরেকবার এ পাশ করছি। থানার মুভমেন্ট লক্ষ করছি।

হঠাৎ শুনি, উত্তর দিক থেকে হাজারো কণ্ঠের একটা গমগম ধ্বনি! চকিতেই আমার চোখ অশ্রুতে ভিজে গেলো। সব ভুলে বিশাল চওড়া রোড ডিভাইডার একলাফে পার হতে গিয়ে উল্টে পরলাম। পড়িমড়ি করে দৌড় দিলাম, মিছিলের দিকে। ‘দফা এক, দাবি এক, শেখ হাসিনার পদত্যাগ’ ‘খুনী হাসিনার পদত্যাগ’- স্লোগানে মিছিলে যুক্ত হতে হতেই মামুনকে আবার কল করলাম। তিনি বললেন, এক্ষুনি আসছেন।

আমি মিছিলে মিশে গেলাম। কতশত মানুষ! শিশু কোলে মা, লাঠি হাতে বয়স্ক নারী-পুরুষ, মাথায় পতাকা বাধা তরুণ-যুবা। আর দু’পাশে মোটরসাইকেল বোঝাই শুকনো খাবার ও পানি বোঝাই বেশ কয়েকটি মোটর সাইকেল। সবাই মিরপুর ডিওএইচএসের বাসিন্দা, হাজার তিনেক সব বয়সী মানুষ।

আমার হাতে কে যেনো একটা লাঠি তুলে দিলো। গর্জে উঠে আগে বাড়লাম। দু’পাশে দাঁড়ানো আরো বস্তিবাসী, বিহারী নারী-পুরুষকে গলার সব জোর এক করে বলতে লাগলাম, ‘আসেন ভাই, আসেন। এটাই শেষ সুযোগ। হাসিনা থাকলে কাউকে বাঁচতে দিবে না। আসেন, একবার মরে অন্তত ভবিষ্যত প্রজন্মকে বাঁচাই। আপনি নামলেই খুনী পালাতে বাধ্য।’ বৃথাই চেঁচালাম। দু’একজন বাদে আর কেউ এলো না।

এরমধ্যেই মামুন আবার কল করলে, পেছনে এসে ওনাকে নিয়ে একটা মোটর রিকশায় চেপে কালশী মোড়ে পৌঁছেই মিছিলের একদম সামনের সারিতে চলে গেলাম দু’জনে। শ্লোগান ধরলাম। পথে দেখলাম, আগের রাতেও রাস্তা পাহারা দেওয়া গুণ্ডালীগের জন্য খাবার রান্না করা পাতিলগুলো পরে আছে, লীগ নাই। সাহস বাড়লো।

সব ভয় তুচ্ছ করে সামনের সারিতে শ্লোগান দিতে দিতে যাচ্ছি। কন্ঠ ভেজা, চোখে পানি। এরমধ্যেই লিকলিকে শরীরের এক তরুন হাতে একটা রড নিয়ে পুলিশ আর লীগের খোঁজে বারবার মিছিল ছেড়ে দৌড়ে আগে চলে যাওয়ার চেষ্টা করছে। ওকে জড়িয়ে ধরে, কপালে চুমু দিয়ে খানিকটা নিবৃত করলাম।

পৌঁছে গেলাম ইসিবি চত্বরে। পুরো চত্বর যেনো তাহরীর স্কয়ার! টুকরো ইট, ভাঙ্গা ডাল ছড়িয়ে আছে রাস্তাজুড়ে। মিছিল মোড়ে এসে থেমে গেলো। কারণ ফ্লাইওভারের গোড়ায় একপাল সঙ্গীন পুলিশ! উপরে ঢালে কিছু মিডিয়ার গাড়ি। দূর থেকে ছবি নিচ্ছে।

বেলা তখন প্রায় সাড়ে এগারটা। মিছিল তো থেমে গেলো, কিন্তু আশাপাশের সমস্ত লোহা, টিন আর দোকানের সাটারে মূহুর্মূহু বাড়ি আর স্লোগানে যেনো যুদ্ধের দামামা বাজছে। মিছিল আগায় না, পুলিশও সরে না। হঠাৎ করে পকেট থেকে মিডিয়ার আইডি কার্ড বের করে, গলায় ঝুলিয়েই আমি দিলাম পুলিশের দিকে দৌড়, আমার পেছনে মামুনও। তার পেছনে আরো কয়েকজন। পুলিশ তাদের অস্ত্র উদ্যত করলো। পজিশন নিলো। আমি থেমে গিয়ে পেছনের সবাইকে বললাম, আপনারা মিছিলে ফিরে যান, আমি আর উনি (মামুন) পুলিশের সাথে কথা বলছি।

দৌড়ে দু’হাত উপরে তুলে পুলিশকে গিয়ে বললাম, ‘এরা সবাই আর্মির পরিবারের লোকজন, একটা গুলিও করবেন না। গুলি করলে কয়জন মরবে জানি না, কিন্তু আপনারা একটাও বেঁচে ফিরবেন না।’ একজন পুলিশ অফিসার বললো, ‘না না, আমরা গুলি করবো না।’ এরপর পুলিশ দ্রুত সব গুছিয়ে নিয়ে ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে সরে গেলো। আমি দৌড়ে উপরে উঠে দেখলাম, Tamim Ahmed দাঁড়িয়ে ভিডিও নেওয়ার, একটা পিটিসি দেওয়ার চেষ্টা করছে৷ পেছনে তাকিয়ে দেখি পুলিশ সরে যাওয়ায় মিছিলও প্রায় ফ্লাইওভারে উঠে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি তামিমকে বললাম গাড়ি ঘুরিয়ে নিতে। আমার তো উদ্দেশ্য গণভবন কিংবা শাহবাগ। যত দ্রুত পৌঁছাতে পারি।

তামিম কাজ শেষ করেই গাড়িতে উঠলো। দরজা খোলা রেখে র্যাডিসনের সামনে দিয়ে নামতেই প্রায় শ’খানেক ছাত্র-জনতার মুখোমুখি! টিভি মিডিয়ার গাড়ি দেখেই তারা দিলো ধাওয়া।

দ্রুত গাড়ি ব্যাক গিয়ারে দিয়ে উল্টোপথে বনানীর দিকে যাত্রা করলাম। এরমাঝেই শুনলাম, আব্দুল্লাহপুরে আর বিএনএস টাওয়ারের সামনে লাখো জনতাকে আটকে রেখেছে আর্মি পুলিশ। যেতে যেতে বনানীর বিভিন্ন গলির মুখে উৎকন্ঠিত মানুষের মুখ দেখলাম। মহাখালী ফ্লাইওভারের নিচে নেমেই দেখি, জাহঙ্গীর গেটে আর্মির ব্যারিকেড। একটুখানি ফাঁকা জায়গা মাঝে, ওটা দিয়ে বের হয়ে পিএম কার্যালয়ের সামনে দেখলাম, পুলিশ ব্যারিকেড তুলে নিচ্ছে, ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। বুকে হুট করেই কেমন যেনো শক্তি চলে এলো! বিজয় স্মরণী ঘুরে খামারবাড়ি মোড়ে গিয়েও দেখি, আর্মির ব্যারিকেড। কাউকে সংসদের সামনে যেতে দিচ্ছে না।

গাড়ি বামে ঘুরিয়ে ফার্মগেট সিগন্যালে আসতেই দেখি একটা এসএসএফের গাড়ি অল্প করে গ্লাস নামিয়ে ট্রাফিক বক্সে থাকা পুলিশদের কিছু বললো, দেখলাম যে কয়জন পুলিশ ছিলো, তারা নিমিষেই পাততারি গুটিয়ে হাওয়া হয়ে গেলো! ওই গাড়িটাও দ্রুত চলে গেলো জাহাঙ্গীর গেটের দিকে।

বুঝে গেলাম, কিছু একটা হয়ে গেছে। দুরুদুর বুকে বাংলামোটর নেমে দেখি সব ফকফকা! কোথাও কেউ নেই! এরমাঝেই শুনি, সেনাপ্রধান নাকি জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিবে! নিশ্চিত হয়ে গেলাম, খুনী আর ক্ষমতায় নেই। কারণ সেনাপ্রধান জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেওয়ার কথা না! তাড়াতাড়ি উপরে উঠলাম৷ সরাসরি একটা বিশেষ কক্ষে। উদ্দেশ্য, ২৬ জুলাই থেকে আমার নিউজ ছাড়ার পেছনের কারণ জানা!

কারণ জানলাম, ওই কক্ষে বসেই হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার খবরটাও নিশ্চিত হলাম৷ সাথে পরদিন থেকে আবার নিউজে ফেরার কনফার্মেশনও নিলাম। ওখান থেকে নেমেই সোজা শাহবাগের দিকে হাঁটা শুরু করলাম৷ কারণ তখনও ফার্মগেট দিয়ে গণভবনের দিকে যাওয়া বন্ধ।

হাঁটছি, চোখ বন্ধ করে হাঁটছি। কাঁদছি, আর সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। কাঁটাবনে পৌঁছে চোখ বন্ধ থাকা অবস্থাতেই বুঝতে পারলাম, কেউ একজন পেছন থেকে আমাকে জাপটে ধরেছে। পছনে ঘুরে দেখলাম Syed Mohammed Tafhim ভাইয়ের দুই ভাই। আলিঙ্গন করলাম৷ ততক্ষণে দক্ষিণের সব পথ শাহবাগে মিলেছে। মানুষ কাঁদছে, হাসছে, পাগলের মত উল্লাস করছে৷ শাহবাগ পৌঁছানোর পর মূহুর্তেই দেখি পুরো চত্বর মানুষে ভরে উঠেছে৷ কিন্তু তখনও টিএসসির দিকে যেতে পুলিশ-আর্মি বাধা দিচ্ছে।

এরমাঝেই শ্লোগান ধরলাম, ‘লজ্জায় বাঁচি না, কই গেলিরে হাসিনা’ ‘লজ্জায় বাঁচি না, পলাইলি কেন্ হাসিনা।’ ‘পলাইছেরে পলাইছে, খুনী হাসিনা পলাইছে!’ শত মানুষ আমার কন্ঠে শ্লোগান ধরেছে৷

চোখে পানি, হৃদয়ে শুকরিয়া, মুখে শ্লোগান। বেশ কিছুক্ষণ সেখানে থেকে এবার রওনা দিলাম গণবভন। আরেক গল্প, আরেক ইতিহাস। সময় করে কাল আবার বাকি অংশ লিখবো।

এই রাতে, শুধু এতটুকুই বলি, হাসিনা ছিলো আমাদের কোষ্ঠকাঠিন্যে আটকে যাওয়া গু। ৫ আগস্ট আমরা সেই গু পাশের নর্দমায় ছুড়ে ফেলে প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেলেছি। হাসিনা নামক গু ঝেড়ে ফেলতে পেরেছি, এটাই ৫ আগস্টের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। বাকিসব প্রত্যাশাও নিশ্চয়ই একদিন প্রাপ্তি হবেই!

সবশেষে আবারও শ্লোগান তুলি- ‘পলাইছেরে পলাইছে, খুনী হাসিনা পলাইছে।’

এতিম! তোমরা দুঃখ করো, ষড়যন্ত্র করো, গুজব ছড়াও। কিন্তু তোমাদের আপা আর ফিরবে না, এটা মেনে নাও।

সবাইকে ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থান দিবসের শুভেচ্ছা। শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা। আর ভবিষ্যত যে কোনো স্বৈরাচারের জন্য সাবধান বাণী- ‘শহীদ হই নি, তাই বলে শাহাদতের আশা মরে যায় নি। আমরা জেগে আছি কোটি জনতা, বুকে আছে দেশের জন্য শহীদি মৃত্যুর তীব্র আকাঙ্খা।’

বিতার্কিক ও সংবাদ উপস্থাপক জাফর সাদিকের ফেসবুক পোস্ট

You may also like

প্রকাশক : মানজুর এলাহী

সম্পাদক : হামীম কেফায়েত

ব‌ইচিত্র পাবলিশার্স
প্যারিদাস রোড, বাংলাবাজার, ঢাকা ১১০০
যোগাযোগ : +8801712813999
ইমেইল : news@dhakabarta.net