ফরহাদ ইব্রাগিমভ ।।
২০২৪ সালের ১ জুলাই তালেবান দূত গুল হাসান রুশ উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রে রুদেনকোর কাছে তার পরিচয়পত্রের কপি জমা দেন। মাত্র দুদিন পর, মস্কো আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে— ‘ইসলামিক আমিরাত অব আফগানিস্তান’ এখন কূটনৈতিক, রাজনৈতিক ও প্রতীকী অর্থে রাশিয়ার স্বীকৃতি পেয়েছে।
এই সিদ্ধান্তের পেছনে আরও বড় অর্থ লুকিয়ে আছে। ২০২১ সালে তালেবান ক্ষমতায় ফেরার পর প্রথমবারের মতো কোনো প্রভাবশালী বিশ্বশক্তি তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে বৈধ অংশীদার হিসেবে গ্রহণ করল।
এর আগে, চলতি বছরের এপ্রিলে রাশিয়া তাদের নিজস্ব ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ তালিকা থেকে তালেবানকে বাদ দেয়— যা দুই দশকের পুরনো একটি অবস্থান। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, এ স্বীকৃতি নিরাপত্তা সহযোগিতা, অর্থনৈতিক সংলাপ ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ।
রাশিয়ার কৌশলগত স্বার্থ
এই স্বীকৃতি নিছক কূটনীতি নয়— এটি নিরাপত্তার বিষয়। এখন তালেবানের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সম্পর্কের মাধ্যমে রাশিয়া ‘আসল সহযোগিতা’ দাবি করতে পারবে। কেননা ২০২৪ সালের মার্চে মস্কোর ক্রোকাস সিটি হলে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পেছনে ছিল আইএসের খোরাসান শাখা, যারা তালেবানকে ‘নرمপন্থী’ মনে করে এবং রাশিয়াকে শত্রু বলে গণ্য করে।
এই হামলার পর ক্রেমলিনের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যায়। যেহেতু তালেবান এখন আফগানিস্তানে বাস্তব ক্ষমতাসীন, তাদের সঙ্গে কাজ করাই কৌশলগত আবশ্যকতা হয়ে দাঁড়ায়। প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ২০২৪ সালে তালেবানকে সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ের ‘অংশীদার’ হিসেবে অভিহিত করেন।
বাণিজ্য ও ভূরাজনীতি
এই স্বীকৃতির মাধ্যমে রাশিয়ার সামনে আফগান বাজারে প্রবেশের সুযোগ তৈরি হয়। লিথিয়ামসহ মূল্যবান খনিজসম্পদে ভরপুর দেশটি রাশিয়ান কোম্পানিগুলোর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে। এ ছাড়া ইতোমধ্যে আফগান কৃষিপণ্য যেমন শুকনো ফল, ভেষজ ইত্যাদি রাশিয়ার বাজারে জায়গা করে নিচ্ছে।
ভূগোলও রাশিয়ার পক্ষে কথা বলছে। আফগানিস্তান মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার সংযোগস্থল, যা রাশিয়ার জন্য পাকিস্তান, ভারত ও ভারত মহাসাগরের দিকেও বাণিজ্যিক করিডর খুলে দেয়।
আঞ্চলিক স্থিতিশীলতায় রাশিয়ার তৎপরতা
রাশিয়া এর আগেও মধ্য এশিয়ায় মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। যেমন ১৯৯৭ সালে তাজিকিস্তানের গৃহযুদ্ধ বন্ধে শান্তিচুক্তি করে দিয়েছিল মস্কো। এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এবারও তালেবান ও তাজিকিস্তান বা তুর্কমেনিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা কমাতে রাশিয়া সক্রিয় ভূমিকা নিতে পারবে।
পশ্চিমারা চেয়ে চেয়ে দেখছে
ওয়াশিংটন ও ব্রাসেলস এখনো আফগানিস্তানকে ‘ব্যর্থতা’র প্রতীক হিসেবে দেখে। আনুষ্ঠানিকভাবে তালেবান এখনও ‘অবাঞ্ছিত’, যদিও পর্দার আড়ালে যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু কেউই এখন পর্যন্ত তাদের স্বীকৃতি দিতে সাহস করেনি।
রাশিয়া সেই সাহস দেখিয়েছে— এবং সেটিই এখন ভূরাজনীতির খেলায় তাকে প্রথম সারিতে বসিয়েছে।
শেষ কথা
তালেবান শাসিত আফগানিস্তান এখন আর শুধু একটি ঝুঁকি নয়, বরং রাশিয়ার জন্য এক সম্ভাবনাময় সেতুবন্ধন— যা তাকে নতুন বাণিজ্যিক, নিরাপত্তা ও কৌশলগত জায়গায় নিয়ে যেতে পারে। গুলি ছোড়ার দরকার হয়নি, কিন্তু মস্কো আসন পেতে বসে গেছে।
লেখক : অর্থনীতি অনুষদের প্রভাষক, রুডেন বিশ্ববিদ্যালয়; অতিথি লেকচারার, রাশিয়ার প্রেসিডেনশিয়াল একাডেমি অফ ন্যাশনাল ইকোনমি অ্যান্ড পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন