গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি ।।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) ঘোষিত ‘জুলাই পদযাত্রা’ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে গোপালগঞ্জে টানা কয়েকদিন ধরে চলা উত্তেজনা ও সহিংসতা বৃহস্পতিবারও থামেনি। বুধবারের সংঘর্ষের জেরে ওই রাত থেকেই কারফিউ জারি করা হয়। বৃহস্পতিবার দুপুরে কারফিউ আংশিক শিথিল করা হলেও পরে তা আবার অনির্দিষ্টকালের জন্য বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এলাকাজুড়ে বিরাজ করছে অস্থিরতা, আতঙ্ক আর রাজনৈতিক উত্তেজনা।
বুধবার এনসিপির ঘোষিত পদযাত্রা ঘিরে সকাল থেকেই গোপালগঞ্জে ছিল থমথমে পরিবেশ। তবে বিকেল থেকে পরিস্থিতি দ্রুত অবনতির দিকে যায়। আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা এনসিপির কর্মীদের ওপর হামলা চালায় বলে অভিযোগ উঠেছে। সংঘর্ষে পুলিশের গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়, ইউএনওর বহরে হামলা চালানো হয় এবং ককটেল বিস্ফোরণ ঘটে। সংঘর্ষে চারজন নিহত হন, যাঁদের মধ্যে তিনজন গুলিবিদ্ধ বলে জানা গেছে। আহত হয়েছেন অন্তত ৫০ জন।
বুধবার রাত থেকে গোপালগঞ্জ শহর এবং আশপাশের এলাকায় কারফিউ জারি করা হয়। বৃহস্পতিবার দুপুরে কারফিউ তিন ঘণ্টার জন্য শিথিল করা হয়—বেলা ১১টা থেকে ২টা পর্যন্ত। এরপর আবার অনির্দিষ্টকালের জন্য মেয়াদ বাড়িয়ে দেওয়া হয়। তবে শুক্রবার সকাল থেকে কিছুটা স্বস্তি দেখা গেছে। আন্তজেলা বাস চলাচল শুরু হয়েছে, বাজার ও সড়কে মানুষের উপস্থিতিও ছিল চোখে পড়ার মতো। রিকশা, মাহেন্দ্র ও ইজিবাইকও স্বাভাবিকভাবে চলাচল করেছে।
গোপালগঞ্জ শহরের কাঁচাবাজার, লঞ্চঘাট ও বিসিক এলাকায় মানুষের ব্যস্ততা ছিল স্পষ্ট। একজন রিকশাচালক বলেন, ‘পেটের দায়ে বের হয়েছি। দুই দিন ঘরে বসে ছিলাম। এখন আর ঘরে থাকলে পেটে ভাত যাবে না।’
ব্যবসায়ীরা জানান, সাম্প্রতিক অস্থিরতায় তাঁদের ব্যবসা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আম নিয়ে আসা একজন ব্যবসায়ী বলেন, ‘গত দুই দিন কিছুই বিক্রি করতে পারিনি। সব পচে গেল।’

গোপালগঞ্জের সমাবেশ মঞ্চে এনসিপির নেতারা
নিহত চারজনের মধ্যে রয়েছেন রমজান শেখ, দীপ্ত সরকার, ইলিয়াস শেখ ও শরিফুল মাতুব্বর। তাঁদের মধ্যে রমজান ও দীপ্তর পরিবার দাবি করেছে, তাঁরা রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। এই বক্তব্য এনসিপির কৌশলগত অবস্থানকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এদিকে এনসিপির একাংশ বলছে, পদযাত্রা নিয়ে আগে থেকেই সংঘর্ষের ইঙ্গিত ছিল, কিন্তু প্রশাসন কোনো প্রস্তুতি নেয়নি।
তরুণ আইনজীবী হাবিবুর রহমান একটি ফেসবুক পোস্টে প্রশ্ন তুলেছেন—শেখ হাসিনার শাসনামলে সংঘর্ষে ৪ জন মারা গেলে সেটি নিছকই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, অথচ ইউনুস সরকারের সময় এরকম ঘটনা ঘটলে সেটিকে গুম-খুন বলা হতো কেন? তিনি আরও লিখেছেন, এনসিপির নেতৃত্বে থাকা একাধিক ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি আজ চুপ কেন?

সেনাবাহিনীর এপিসিতে করে গোপালগঞ্জ ছাড়েন এনসিপি নেতারা
নিহতদের পরিবার যখন শোক ও ক্ষোভে স্তব্ধ, এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তখনও আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো ক্ষতিপূরণ বা আইনি সহায়তার ঘোষণা দেয়নি। দলের অভ্যন্তরে নানা মতবিরোধ, বিশেষ করে ধর্মীয় মূল্যবোধ নিয়ে, পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এনসিপির পদযাত্রা রাজনীতিতে নতুন সম্ভাবনা ও উত্তেজনার জন্ম দিয়েছে। কিন্তু সহিংসতা ও হতাহতের ঘটনা দলটিকে একটি কঠিন প্রশ্নের মুখে ফেলেছে—তারা কি সত্যিই জনতার রাজনীতি করছে, নাকি কৌশলগতভাবে একটি অনির্বাচিত শূন্যতায় প্রবেশ করতে চাইছে?