সৈয়দ হাসসান ।।
বাংলাদেশের ব্যাংক খাত ধ্বংসের পথে যাত্রা শুরু করে আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর। সে সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন ড. আতিউর রহমান। তার মেয়াদকালে দেশের ব্যাংক খাত সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত হয়ে ওঠে। রিজার্ভ চুরি, ইচ্ছেমতো নতুন ব্যাংক অনুমোদন, ব্যাংক খাতের বড় কেলেঙ্কারির সূচনা ইত্যাদি কারণে তিনি বিতর্কিত হয়ে ওঠেন। প্রায় সাত বছর দায়িত্ব পালন শেষে পদত্যাগ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় ফিরে আসেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. আতিউর রহমান ২০০৯ সালের ১ মে গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেন। প্রথমে চার বছরের জন্য নিয়োগ দেয়া হলেও, পরে তার মেয়াদ আরও তিন বছরের জন্য বাড়ানো হয়েছিল। তবে রিজার্ভ চুরির তথ্য গোপন রাখার দায়ে নানা মহলের সমালোচনার মধ্যে ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন। এর আগে তিনি রিজার্ভ চুরির তথ্য ২৪ দিন গোপন রাখেন।
ফরাসউদ্দিন কমিটি তাদের তদন্ত প্রতিবেদনে এ নিয়ে বলেছিল, ‘অর্থ চুরির তথ্য উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে গোপন করার কোনোই যৌক্তিকতা নেই, বরং গর্হিত অপরাধ। আর বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, এমনকি অর্থ মন্ত্রণালয়কে না জানানোটা অসদাচরণ।’ ২৯ ফেব্রুয়ারি ফিলিপাইনের দ্য ইনকুয়ারার পত্রিকায় বাংলাদেশের রিজার্ভ চুরির সংবাদ প্রকাশিত হলে ১ মার্চ গভর্নর গোয়েন্দা সংস্থাকে জানান। এরপর তিনি প্রধানমন্ত্রীকে এসএমএস পাঠান এবং ৭ মার্চ অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন।

পদত্যাগের পর গভর্নর হাউসের বাগানে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছেন ড. আতিউর রহমান। ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ তোলা ছবি।
যদিও রিজার্ভ চুরি হয়েছিল ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার রাতে। বাংলাদেশ ব্যাংক এই চুরির বিষয়ে নিশ্চিত হয় ৬ ফেব্রুয়ারি শনিবার দুপুরে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বা অর্থমন্ত্রী কাউকেই বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে এ তথ্য জানানো হয়নি। এর কারণ জানতে চেয়েছিল তদন্ত কমিটি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন ডেপুটি গভর্নর আবুল কাসেম তথ্য গোপনের বিষয়ে লিখিত বক্তব্যে বলেছেন, ৪ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার রাতে চুরি হলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে তা ধরা পড়ে ৬ ফেব্রুয়ারি শনিবার। অর্থ চুরির ঘটনা নিশ্চিত হওয়ার পর শনিবার দুপুরে তিনি বিষয়টি গভর্নর আতিউর রহমানকে জানান এবং থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করার পরামর্শ দেন। একই সঙ্গে জিডির অনুলিপি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং অর্থ মন্ত্রণালয়কে পাঠানোর জন্য তিনি বলেন। কিন্তু গভর্নর তাকে জানান, জিডি করলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা হয়রানির শিকার হবেন এবং আতঙ্কিত হয়ে পড়বেন। আর অর্থমন্ত্রী কোথায় কী বলে ফেলেন ঠিক নেই। এমনকি অভ্যন্তরীণ তদন্তও গোপনে করার জন্য তিনি ব্যাংক কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন।
শুধু রিজার্ভ চুরির তথ্য গোপনই নয়, বাছবিচার ছাড়া নতুন ব্যাংক অনুমোদন দিয়েছিলেন ড. আতিউর রহমান। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার কথা চিন্তা করে নতুন ব্যাংক অনুমোদনের বিপক্ষে মতামত দিয়েছিলেন আর্থিক খাত বিশেষজ্ঞরা। তবে সেগুলো বিবেচনায় না নিয়ে ৯টি ব্যাংক অনুমোদন দেন তিনি। এসব ব্যাংকের মালিকানায় ছিল আওয়ামী লীগের বিভিন্ন মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও নেতারা। অনুমোদনের পর সব কয়টি ব্যাংক লুটপাটের কারণে কয়েক বছরের মধ্যে দুর্বল অবস্থায় চলে যায়।
আতিউর রহমানের সময় খেলাপি ঋণও এক লাফে আড়াই গুণ হয়ে যায়। ড. আতিউর রহমানের প্রথম মেয়াদে চার বছরে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পায় প্রায় ২০ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। দ্বিতীয় মেয়াদে খেলাপি বাড়ে ১৬ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। তার দুই মেয়াদে ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণ বেড়েছিল ৩৬ হাজার ৯৩১ কোটি টাকা। তিনি দায়িত্ব নেয়ার সময় ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৪৮০ কোটি টাকা। পদত্যাগ করার সময় ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ রেখে যান ৫৯ হাজার ৪১১ কোটি টাকা। ব্যাংক খাতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণ বেড়েছিল এ গভর্নরের আমলে।
যদিও তার আগে ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের মেয়াদকালে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বেড়েছিল মাত্র ৪ হাজার ৯৭০ কোটি টাকা। তার আগে ড. ফখরুদ্দীন আহমদের মেয়াদে খেলাপি ঋণ বেড়েছিল ৬ হাজার ৯০ কোটি টাকা ও ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের আমলে খেলাপি বাড়ে ৩ হাজার ৬৯৭ কোটি টাকা। লুৎফুর রহমান সরকারের সময় ৮ হাজার ৮৪৯ কোটি টাকা এবং খোরশেদ আলমের সময়ে ৪ হাজার ৪৮০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পায়। ড. আতিউর রহমানের সময় ব্যাংক খাতে সবচেয়ে আলোচিত হলমার্ক কেলেঙ্কারি, বেসিক ব্যাংক লুটপাটসহ ব্যাংক খাতে বড় বড় অনিয়ম ঘটে। তবে তিনি এসবের বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকাই রাখেননি।