প্রোফাইল ডেস্ক ।।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল অধ্যায়ের নাম সৈয়দ আলী আহসান। তিনি শুধু একজন কবি বা সাহিত্যিক নন, ছিলেন একাধারে গবেষক, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, সম্পাদক, শিক্ষাবিদ ও প্রশাসক। ১৯২২ সালের ২৬ মার্চ মাগুরা জেলার আলোকদিয়া গ্রামে তাঁর জন্ম। পিতামহ ছিলেন সুফি সাধক ও জমিদার, পিতা সৈয়দ আলী হামেদ ছিলেন স্কুল ইন্সপেক্টর। তাঁর মাতা সৈয়দা কামরুন্নেগার খাতুন নবাবগঞ্জের আগলা গ্রামের পীর পরিবারের সন্তান। পিতৃ ও মাতৃ উভয় বংশ থেকেই তিনি পেয়েছিলেন সুফিবাদী পরিবেশের অনুপ্রেরণা।
ছাত্রজীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। আর্মানিটোলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। এখানেই তাঁর সাহিত্যিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক আত্মপ্রকাশ ঘটে। ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই তিনি সমান দক্ষ ছিলেন। ছাত্রাবস্থাতেই সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্পাদিত ‘পরিচয়’ পত্রিকায় তাঁর প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এই সময়েই তিনি পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ গঠন করেন, যা মুসলিম সংস্কৃতি ও পুঁথিসাহিত্যের পুনরুদ্ধার এবং আধুনিকতার সমন্বয়ে এক নতুন সাহিত্যচর্চার পথ খুলে দেয়।
১৯৪৫ সালে তিনি অল ইন্ডিয়া রেডিওর কলকাতা কেন্দ্রে যোগ দেন। সেখান থেকে ঢাকা রেডিওতে এবং পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। এরপর করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং ‘Bengali Literary Review’ নামক পত্রিকা সম্পাদনা করেন, যা বাংলা মুসলিম সাহিত্য নিয়ে ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত একটি ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগ।
১৯৬০ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলা একাডেমির পরিচালক ছিলেন। এ সময় তিনি একাডেমিকে একটি কার্যকর সাংস্কৃতিক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলেন। পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপক ও কলা অনুষদের ডীন হিসেবে কাজ করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ভারতে চলে যান এবং কলকাতায় অবস্থানকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত হন, যেখানে ‘চেনা কণ্ঠ’ ছদ্মনামে শব্দসৈনিক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
স্বাধীনতার পর তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হন এবং বিশ্ববিদ্যালয়টিকে আধুনিক ও কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলেন। তিনি বাংলা ভাষার সাংবিধানিক রূপ নির্ধারণ, শিল্পকলা একাডেমির গঠনতন্ত্র প্রণয়নসহ নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দেন। ১৯৭৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হন এবং পরে প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। জীবনের শেষ পর্যায়ে দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন।
কবিতা ও প্রবন্ধে তাঁর চিন্তাধারা ছিল গভীর ও বুদ্ধিদীপ্ত। ‘একক সন্ধ্যায় বসন্ত’, ‘অনেক আকাশ’, ‘উচ্চারণ’, ‘সহসা সচকিত’, ‘আমার প্রতিদিনের শব্দ’ তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। তাঁর কবিতায় বিমূর্ত উপমা ও আধুনিক উপস্থাপনা পাঠককে নতুন মাত্রায় নিয়ে যায়। ‘প্রার্থনা’ ও ‘আমার পূর্ববাংলা’ তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতার মধ্যে অন্যতম। প্রবন্ধে তিনি বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগ বিশ্লেষণ করেন, রবীন্দ্রনাথ, মধুসূদন, জীবনানন্দসহ বহু কবির সাহিত্য বিশ্লেষণ করেন। তিনি একাধিক সাহিত্যগ্রন্থ অনুবাদ করেন—ইকবাল, গল, হুইটম্যানসহ বহু কবির।
তাঁর সাহিত্যিক অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬৮), একুশে পদক (১৯৮২), স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৮৭), জাতীয় অধ্যাপক (১৯৮৯) সহ বহু পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হন। তিনি নোবেল সাহিত্য পুরস্কার কমিটির উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করেন (১৯৭৬–১৯৮২)। ফরাসি সরকারের ‘Officer de l’ordre des Arts et des Lettres’ উপাধিও লাভ করেন।
২০০২ সালের ২৫ জুলাই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদসংলগ্ন কবরস্থানে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়। মৃত্যুর পরও তাঁর সাহিত্য ও শিক্ষাবিষয়ক কাজ বাংলা সাহিত্য ও জাতীয় ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।