মঙ্গলবার, আগস্ট ১৯, ২০২৫

মুহাম্মদ জিয়া-উল-হক

সমর্থকেরা তাঁকে ‘মুজাহিদীনদের রক্ষাকর্তা’ বা ‘ইসলামী পুনর্জাগরণের নেতা’ বলে দেখলেও সমালোচকেরা মনে করেন, জিয়ার শাসন পাকিস্তানে সামরিক প্রভাব, স্বৈরতন্ত্র ও ধর্মীয় চরমপন্থার বীজ বপন করেছে, যার মাশুল দেশটি এখনও দিচ্ছে।

by ঢাকাবার্তা
মুহাম্মদ জিয়া-উল-হক

প্রোফাইল ডেস্ক ।। 

মুহাম্মদ জিয়া-উল-হক (উর্দু: محمد ضیاء الحق‎‎; জন্ম: ১২ আগস্ট ১৯২৪ – মৃত্যু: ১৭ আগস্ট ১৯৮৮) পাকিস্তানের সামরিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের একজন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা থেকে তিনি ধীরে ধীরে রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে ওঠেন এবং এক দশকেরও বেশি সময় ধরে পাকিস্তান শাসন করেন। তাঁর ক্ষমতায় আরোহণ, শাসনপদ্ধতি, ভুট্টোর ফাঁসি, ইসলামীকরণের নীতি এবং রহস্যময় মৃত্যু—সব মিলিয়ে তিনি পাকিস্তানের ইতিহাসে আজও আলোচিত-সমালোচিত এক নাম।

১৯২৪ সালের ১২ আগস্ট ব্রিটিশ ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের জলন্ধরে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন জিয়া-উল-হক। তাঁর বাবা মুহাম্মদ আকবর আলী দিল্লির আর্মি জেনারেল হেডকোয়ার্টার্সে কর্মরত ছিলেন। শৈশব ও কৈশোর কেটেছে সিমলায়। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট স্টিফেন’স কলেজ থেকে ১৯৪৩ সালে বিএ ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। একই বছরে দেরাদুনের রয়্যাল ইন্ডিয়ান মিলিটারি একাডেমিতে ভর্তি হন এবং ১৯৪৫ সালে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মিতে কমিশন লাভ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে বার্মা, মালায় ও ইন্দোনেশিয়ায় দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

রাওয়ালপিন্ডিতে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ও জিয়া-উল-হক, ১৯৮৬ সালে তোলা ছবি।

রাওয়ালপিন্ডিতে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও জিয়া-উল-হক, ১৯৮৬ সালে তোলা ছবি।

ভারত বিভক্তির পর ১৯৪৭ সালে তাঁর পরিবার পাকিস্তানে চলে আসে। জিয়া পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং দ্রুত পদোন্নতি লাভ করতে থাকেন।

১৯৬২ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে সামরিক প্রশিক্ষণ নেন জিয়া। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে তিনি ১০১ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৭ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত তিনি জর্ডানে পাকিস্তানের সামরিক প্রশিক্ষণ মিশনের প্রধান ছিলেন এবং ‘ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর’ বিদ্রোহ দমনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি ডিভিশনের ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন।

১৯৭৫ সালে তিনি লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে উন্নীত হন এবং অবশেষে ১৯৭৬ সালে প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো তাঁকে সেনাপ্রধান নিযুক্ত করেন। সাতজন জ্যেষ্ঠ লেফটেন্যান্ট জেনারেলকে পাশ কাটিয়ে জিয়াকে বেছে নেওয়ার পেছনে ভুট্টোর বিশ্বাস ছিল—জিয়া তাঁর প্রতি সর্বাধিক অনুগত থাকবেন।

১৯৭৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগে বিরোধী দলগুলো তীব্র আন্দোলনে নামে। রাজনৈতিক অচলাবস্থার সুযোগ নেন জিয়া। ৫ জুলাই ১৯৭৭ সালে ‘অপারেশন ফেয়ার প্লে’ নামে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ভুট্টো সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেন তিনি। ভুট্টোকে ফোনে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হবে, কিন্তু সেটি আর হয়নি।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে জিয়া-উল-হক, ১৯৮৬ সালে তোলা ছবি।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে জিয়া-উল-হক, ১৯৮৬ সালে তোলা ছবি।

ভুট্টোর বিরুদ্ধে পুরোনো একটি হত্যা মামলা নতুন করে খোলা হয় এবং বিতর্কিত বিচারের মাধ্যমে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। দেশ-বিদেশের অসংখ্য অনুরোধ উপেক্ষা করে ১৯৭৯ সালের ৪ এপ্রিল রাওয়ালপিন্ডি কারাগারে তাঁকে ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ইতিহাসবিদদের মতে, এটি ছিল এক প্রকার ‘বিচারিক হত্যাকাণ্ড’।

১৯৭৮ সালে জিয়া নিজেকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন এবং ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকেন। তিনি সামরিক আইন জারি করে সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করেন, গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করেন।

তাঁর শাসনামলের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল—

  • ইসলামীকরণ নীতি: পাকিস্তানকে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রে রূপান্তরের উদ্যোগ নেন। সংবিধান, বিচারব্যবস্থা, শিক্ষা ও সমাজব্যবস্থায় ইসলামী আইন প্রবর্তন করেন।
  • আফগান যুদ্ধ: সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে আফগান মুজাহিদীনদের সমর্থনে তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের সহযোগিতা পান। এ সময় পাকিস্তান আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, কিন্তু একইসঙ্গে দেশে উগ্রবাদের শিকড়ও গেড়ে বসে।
  • পারমাণবিক কর্মসূচি: জিয়ার আমলে পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি গোপনে এগিয়ে যায়।
  • অর্থনীতি: আশির দশকে পাকিস্তানের জিডিপি তুলনামূলকভাবে উন্নত ছিল, তবে অর্থনৈতিক উন্নতির সমান্তরালে গণতান্ত্রিক কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

১৯৮৮ সালের ১৭ আগস্ট বাহাওয়ালপুর থেকে ইসলামাবাদ ফেরার পথে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সি-১৩০বি হারকিউলিস উড়োজাহাজে বিস্ফোরণ ঘটে। প্রেসিডেন্ট জিয়া, জেনারেল আখতার আবদুর রহমান, মার্কিন রাষ্ট্রদূত আরনল্ড রাফেলসহ ৩০ জন নিহত হন।

মুহাম্মদ জিয়া-উল-হক

মুহাম্মদ জিয়া-উল-হক

সরকারি তদন্তে এটি নাশকতা বলেই চিহ্নিত হয়, তবে প্রকৃত কারণ আজও অমীমাংসিত। নানা ষড়যন্ত্রতত্ত্ব প্রচলিত আছে—বিষাক্ত গ্যাস ছড়ানো হয়েছিল, উড়োজাহাজে লুকানো বিস্ফোরক ছিল, কিংবা বাইরে থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়েছিল। জিয়ার ছেলে ইজাজুল হক দাবি করেন, নার্ভ গ্যাস ও বিস্ফোরক একসঙ্গে ব্যবহার করা হয়েছিল। সন্দেহের তীর গিয়েছে সেনাবাহিনীর ভেতরের প্রতিদ্বন্দ্বী, সোভিয়েত, ভারত কিংবা ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার দিকেও।

১৯ আগস্ট ১৯৮৮ সালে ইসলামাবাদের ফয়সল মসজিদের প্রাঙ্গণে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয় জিয়া-উল-হককে।

তাঁর উত্তরাধিকার নিয়ে আজও পাকিস্তানে বিতর্ক থামেনি। সমর্থকেরা তাঁকে ‘মুজাহিদীনদের রক্ষাকর্তা’ বা ‘ইসলামী পুনর্জাগরণের নেতা’ বলে দেখলেও সমালোচকেরা মনে করেন, জিয়ার শাসন পাকিস্তানে সামরিক প্রভাব, স্বৈরতন্ত্র ও ধর্মীয় চরমপন্থার বীজ বপন করেছে, যার মাশুল দেশটি এখনও দিচ্ছে।

মুহাম্মদ জিয়া-উল-হকের জীবন ছিল নাটকীয় উত্থান, অটল শাসন, এবং শেষপর্যন্ত রহস্যঘেরা পতনের এক ইতিহাস, যা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিকে আজও আলোড়িত করে রেখেছে।

You may also like

প্রকাশক : মানজুর এলাহী

সম্পাদক : হামীম কেফায়েত

ব‌ইচিত্র পাবলিশার্স
প্যারিদাস রোড, বাংলাবাজার, ঢাকা ১১০০
যোগাযোগ : +8801712813999
ইমেইল : news@dhakabarta.net