স্টাফ রিপোর্টার ।।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার দেশে ‘আইয়ামে জাহেলিয়া’ প্রতিষ্ঠা করেছিল। বুধবার রাজধানীতে গোপন বন্দিশালা ও টর্চার সেল পরিদর্শন শেষে তিনি একথা বলেন। তিনি মন্তব্য করেন, ‘আইয়ামে জাহেলিয়া বলে একটা কথা আছে না? গত সরকার সেই আইয়ামে জাহেলিয়া প্রতিষ্ঠা করে গেছে সর্বক্ষেত্রে। এই গোপন বন্দিশালা তার একটি নমুনা।’
বুধবার অধ্যাপক ইউনূস উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের সদস্য, ভুক্তভোগী ও সাংবাদিকদের নিয়ে রাজধানীর আগারগাঁও, কচুক্ষেত ও উত্তরা এলাকায় তিনটি গোপন বন্দিশালা পরিদর্শন করেন। এই বন্দিশালাগুলোকে ‘আয়নাঘর’ হিসেবে অভিহিত করা হয়, যা গোপন নির্যাতনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
বন্দিশালাগুলো পরিদর্শনের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন অধ্যাপক ইউনূস। তিনি বলেন, ‘বীভৎস দৃশ্য। নৃশংস জিনিস হয়েছে এখানে। যতটাই শুনি মনে হয় অবিশ্বাস্য, এটা কি আমাদেরই জগৎ, আমাদের সমাজ? যারা নিগৃহীত হয়েছেন, তারাও আমাদের সমাজেরই মানুষ। তাদের মুখ থেকে শুনলাম কী হয়েছে, কোনো ব্যাখ্যা নেই।’
তিনি জানান, বিনা কারণে, বিনা দোষে অসংখ্য ব্যক্তিকে অপহরণ করে এখানে বন্দি রাখা হতো। তাদেরকে সন্ত্রাসী বা জঙ্গি হিসেবে অভিযুক্ত করে নির্মম নির্যাতন চালানো হতো। তিনি আরও বলেন, ‘এই রকম টর্চার সেল সারা দেশে আছে। ধারণা ছিল, এখানে কয়েকটা রয়েছে, কিন্তু এখন শুনছি দেশজুড়ে বিভিন্ন ভার্সনে এমন শত শত বন্দিশালা রয়েছে। কেউ বলছে ৭০০, কেউ বলছে ৮০০, সঠিক সংখ্যা নিরূপণ করা যায়নি।’
বন্দিশালাগুলো চিহ্নিত করার জন্য গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনকে ধন্যবাদ জানান অধ্যাপক ইউনূস। তিনি বলেন, ‘দেশের যে চূড়ান্ত অবনতি হয়েছিল সর্বক্ষেত্রে, এই বন্দিশালা তার একটি প্রতিচ্ছবি। এটা প্রমাণ করে মানুষের মৌলিক মানবাধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত করা হয়েছিল।’
তিনি বলেন, ‘একজন ভুক্তভোগী বলছিলেন, যে খুপরির মধ্যে তাদেরকে রাখা হয়েছে, গ্রামে মুরগির খাঁচাও এর চেয়ে বড় হয়। তাদেরকে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর এভাবে বন্দি করে রাখা হয়েছে। মানুষ হিসেবে সামান্যতম মানবিক অধিকার থেকেও তাদেরকে বঞ্চিত করা হয়েছে।’
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘এই সমাজকে যদি নির্যাতনের এই করুণ অধ্যায় থেকে বের করে আনতে না পারি, তাহলে নতুন সমাজ গড়া সম্ভব হবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘যারা এই বর্বর নির্যাতন চালিয়েছে, তারা আমাদেরই সন্তান, আমাদের ভাই, আমাদের আত্মীয়স্বজন। তাই সমাজকে নির্যাতনমুক্ত করতে হলে আমাদের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।’
গুমের শিকার ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘ন্যায়বিচার যেন পায়, সেটাই এখন প্রধান্য দিতে হবে।’ আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা নতুন বাংলাদেশ ও নতুন পরিবেশ গড়তে চাই। সরকার সে লক্ষ্যে বিভিন্ন কমিশন গঠন করেছে। যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, তার পুনরাবৃত্তি যেন না হয়, সরকার সে লক্ষ্যে কাজ করবে।’
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘এই বন্দিশালাগুলো স্বৈরাচারী শাসনের প্রতিচ্ছবি হিসেবে জাতির জন্য একটি বড় ডকুমেন্ট হয়ে থাকবে। এগুলো সংরক্ষণ করে জাতির সামনে উপস্থাপন করা উচিত, যেন ভবিষ্যতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।’