‘লেখাপড়া করো, এটাই তোমাদের মুক্তির পথ’গাজা উপত্যকা— একটি নাম, যা যুদ্ধ, ধ্বংস আর অবরোধের ছবি মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু এই ছোট্ট ভূখণ্ডে জীবন শুধু কষ্টের গল্প নয়; এখানে আছে সংগ্রাম, আশা আর অদম্য বেঁচে থাকার চেষ্টা। আমরা কথা বলেছি মুনা আল হানানের সঙ্গে। গাজা সিটির একজন স্কুলশিক্ষিকা তিনি, তিন সন্তান ও মাছশিকারি স্বামীর সঙ্গে ধ্বংসাত্মক বাস্তবতায় বসবাস করেন। তিনি আমাদের বলেছেন গাজার প্রশাসন, অর্থনীতি, নাগরিক সেবা, সামাজিক বৈষম্য আর চলাচলের চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে। তার কথায় উঠে এসেছে গাজার জীবনের বহুমাত্রিক চিত্র— যেখানে ধ্বংসের মাঝেও গড়ে ওঠে আকাশচুম্বী আধুনিক ভবন আর কান্নার মধ্যেও বেঁচে থাকে স্বপ্ন। সোশ্যাল মিডিয়ার এক অ্যাপে সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন মানাম মায়মূন।
প্রশ্ন : গাজার প্রশাসন কারা চালায়, সিস্টেমটা কী?
উত্তর: গাজা ২০০৭ সাল থেকে হামাসের নিয়ন্ত্রণে। তারা আমাদের স্কুল, হাসপাতাল, আদালত—এইসব চালায়। তবে সবকিছুতে আন্তর্জাতিক সংস্থার হাত আছে, যেমন জাতিসংঘ বা দাতা দেশগুলো। আমার স্কুলে বাচ্চাদের বইপত্র প্রায়ই UN থেকে আসে। কিন্তু সত্যি বলতে, অতিগুরুত্বপূর্ণ অনেক কিছুই ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে থাকে— বিশেষ করে বিদ্যুৎ, পানি আর আমাদের যাতায়াত ব্যবস্থা। কাগজে-কলমে হামাস আমাদের দৈনন্দিন জীবন চালায় কিন্তু বড় সিদ্ধান্তগুলো বাইরের নিয়ন্ত্রণাধীন। সব মিলিয়ে বলতে পারি, আমরা পাখি হয়ে খোলা খাঁচায় বাঁচি, কিন্তু উড়াল দেওয়া যায় না…।
প্রশ্ন : গাজায় নাগরিক সেবা, যেমন বিদ্যুৎ বা পানি, কীভাবে কাজ করে?
উত্তর: সেবা? (হাসি) এটা আমাদের জীবনের সবচেয়ে কঠিন অংশ। বিদ্যুৎ দিনে মাত্র ২-৪ ঘণ্টা পাই, রাতে বিদ্যুৎহীন থাকা আমাদের নৈমিত্তিক ব্যাপার। আমার বাচ্চারা মোমবাতির আলোয় পড়ে। গাজার একটা ক্ষুদ্রাকৃতির পাওয়ার প্ল্যান্ট আছে কিন্তু জ্বালানির অভাবে প্রায় অচন। ইসরায়েলের বিদ্যুতেই আমরা নির্ভর করি। পানিরও একই অবস্থা, বিশুদ্ধ পানি পাওয়া খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। উপায় না পেয়ে অনেক সময় সমুদ্রের লবণাক্ত পানি পরিশোধন ছাড়াই ব্যবহার করি। টেলিফোন বা ইন্টারনেট? সেটাও ইসরায়েল নিয়ন্ত্রণ করে। ফোর-জি এসেছে অনেক দেরিতে। আমরা চেষ্টা করি। তবু জীবনটা যেন একটা সুতার ওপর হাঁটাচলার মতো।
প্রশ্ন : গাজায় এত হাইরাইজ বিল্ডিং ধ্বংস হতে দেখি, এগুলো কারা বানায়? কীভাবে সম্ভব হয়?
উত্তর: এটা সত্যিই অবাক করার মতো। যুদ্ধে ভবন ভেঙে পড়ে, আবার নতুন ভবন ওঠে! কিছু ধনী লোক আছে, যারা কাতার, দুবাই বা ইউরোপে ব্যবসা করে। তারা টাকা পাঠায় বাড়ি বানাতে। আমার এক ছাত্রের বাবা দুবাইতে কাজ করেন, তাদের ফ্ল্যাটটা চোখ ধাঁধানো। শহরের অন্য ফ্ল্যাটের সাথে একদমই মেলানো যায় না। এছাড়া প্রবাসীদের রেমিট্যান্স, কাতার-তুরস্কের সাহায্য, আর হামাসের নিজস্ব অর্থ— এগুলো দিয়েই বাড়িঘর নির্মাণ হয়। সিমেন্ট, রড এসব মিশরের রাফা সীমান্ত দিয়ে আসে, কখনো কালোবাজারে, কখনো UN-এর প্রকল্পে। কিন্তু এই ভবনগুলো শুধু কিছু মানুষের জন্য, যারা যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় সৌভাগ্য নিয়ে জন্মেছে।
প্রশ্ন : শুনেছি, আপনি মাসে ৪০০ ডলার বাসা ভাড়া দেন। ভাড়া এত বেশি কেন?
উত্তর: হ্যাঁ, তখন আমরা গাজা সিটিতে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া থাকি। ৪০০ ডলার। অনেক শোনায়, তাই না? কিন্তু এখানে বাড়ি-ঘরের অনেক সংকট। যুদ্ধে বাড়িঘর ভাঙে, নাই হয়ে যায়, তাই ভালো-নিরাপদ জায়গায় ফ্ল্যাটের দাম আকাশছোঁয়া। আমাদের ২৩ লাখ মানুষ মাত্র ৩৬৫ বর্গকিলোমিটারে থাকি! আমার স্বামী মাছ ধরেন, আমি শিক্ষকতা করি— দুজনের আয় মিলিয়ে কোনোরকমে ওই ভাড়া দিই। আর প্রবাসীদের পাঠানো টাকার ধাক্কায় বাজার চড়া হয়ে যায়। কিন্তু সবাই তো আর এমন ভাড়া দিতে পারে না। আমার অনেক ছাত্রের পরিবার এবং আত্মীয়স্বজন শরণার্থী শিবিরে থাকে।

গাজার এক স্কুলশিক্ষিকা, গন্তব্যে হেঁটে যাচ্ছেন। প্রতীকী চিত্র।
প্রশ্ন : গাজায় মানুষের পেশা আর আয় কেমন? আপনার মতো শিক্ষকদের বেতন কত?
উত্তর: নিশ্চিত ভবিষ্যত হয়, এমন কাজের সুযোগ গাজায় খুবই কম। অনেকে কৃষি, মাছ ধরা বা ছোট দোকান বা রাস্তার পাশে পণ্য নিয়ে বসে। আমার স্বামীর মতো মাছশিকারিরা অবরোধের কারণে খুব কম আয় করেন। আমি শিক্ষক, আমার মতো শিক্ষকদের বেতন মাসে ৩০০-৫০০ ডলার, সরকারি স্কুলে। বেসরকারি স্কুলে আরও কম। এনজিও-তে কাজ করলে ৩০০-৭০০ ডলার হতে পারে। কেউ কেউ নির্মাণ শ্রমিক, দিনে ৫-১০ ডলার পায়। আর প্রবাসীদের পাঠানো টাকা অনেক পরিবারের জন্য বড় ভরসা। আমার এক ছাত্রের চাচা কাতার থেকে টাকা পাঠান, ওদের জীবনটা একটু ভালো, যৎসামাণ্য বিলাসী।
প্রশ্ন : গাজায় জিনিসপত্রের দাম কেমন? অন্য শহরের সঙ্গে তুলনা করলে?
উত্তর: এখানে দাম কম মনে হলেও আমাদের আয়ের তুলনায় অনেক বেশী। যেমন, ১ লিটার দুধ ১ ডলার, ১ কেজি চাল ১.৫ ডলার। তেলআবিবে দুধ ১.৮ ডলার, চাল ২.৫ ডলার। কায়রোতে দুধ ০.৯ ডলার, চাল ১.২ ডলার। কিন্তু অবরোধের কারণে আমাদের দাম হঠাৎ বেড়ে যায়। আমার বাচ্চাদের জন্য দুধ কিনতে গিয়ে মাঝে মাঝে হিমশিম খাই। আর বিলাসী জিনিস? সেটা শুধু ধনীদের জন্য। ম্যাকডোনাল্ডস-এর মতো ফুডচেইন এখানে নেই, তবে কিছু স্থানীয় দোকানে বিদেশি পণ্য ও খাদ্য পাওয়া যায়, দাম অনেক বেশি।
প্রশ্ন: গাজায় কোন মুদ্রা চলে? অর্থনীতির ব্যাপারটা কেমন?
উত্তর: আমাদের নিজস্ব কোনো মুদ্রা নেই। বেশিরভাগ লেনদেন হয় ইসরায়েলি শেকেলে। দক্ষিণ গাজায় কখনো মিশরীয় পাউন্ড চলে। বড় লেনদেন বা প্রবাসীদের অর্থ আসে ডলারে। হামাস নিজস্ব রাজস্ব আর আন্তর্জাতিক সাহায্য-সহযোগিতা দিয়ে গাজা চালায়। পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিন অথরিটি কখনো কখনো গাজা প্রশাসনের বেতন দেয়, কিন্তু সেটা নিয়মিত নয়। আমার বেতন শেকেলে পাই, কিন্তু দোকানে দাম দেখে মাঝে মাঝে মাথা ঘুরে।
প্রশ্ন : গাজা থেকে পশ্চিম তীর বা ইসরায়েলে যাওয়া কি সহজ?
উত্তর: সহজ? একেবারেই না। পশ্চিম তীরে যেতে ইসরায়েলের অনুমতি লাগে। আমাদের দুটো ভূখণ্ডই ফিলিস্তিনের, কিন্তু মাঝে ইসরায়েলি ভূখণ্ড। তাই চিকিৎসা, শিক্ষা বা ব্যবসার মতো জরুরি কারণ ছাড়া অনুমতি পাওয়া কঠিন। আমার এক ছাত্রের মা উন্নত চিকিৎসার্থে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য ছয় মাস অপেক্ষা করেছিলেন। আর ইসরায়েলে যাওয়া এরচে কঠিন— কেবল গুরুতর চিকিৎসা বা এনজিও কাজের জন্য কিছু লোক যায়। বলা যায় অদৃশ্য দেয়ালে ঘেরা আমাদের জীবন।
প্রশ্ন : বিদেশ যাওয়ার জন্য কী করতে হয়? রাফা সীমান্তের ব্যাপারটা কী?
উত্তর: বিদেশ যাওয়া আমাদের জন্য স্বপ্নের মতো। গাজায় কোনো বিমানবন্দর নেই। ইয়াসির আরাফাত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটা ২০০১ সালে ধ্বংস হয়ে গেছে। তাই আমাদের রাফা সীমান্ত দিয়ে মিশরে যেতে হয়। প্রথমে হামাসের কাছে তালিকায় নাম তুলতে হয়, তারপর মিশরের অনুমতি লাগে। রাফা প্রায়ই বন্ধ থাকে। আমার এক সহকর্মী চিকিৎসার জন্য কায়রো যেতে তিন মাস অপেক্ষা করেছিলেন। সীমান্তে চেকিং, জিজ্ঞাসাবাদ, ঘুষ— সব মিলিয়ে কষ্টের শেষ নেই। কায়রো পৌঁছেও মিশরীয় কর্তৃপক্ষ আটকাতে পারে। তবু এটাই আমাদের একমাত্র পথ।
প্রশ্ন : গাজার জীবনের বৈপরীত্যটা কেমন? ধ্বংসের মাঝেও কীভাবে টিকে থাকেন প্রাণ?
উত্তর: গাজা এক অদ্ভুত জায়গা, পৃথিবীর কোনো ভূখণ্ডে বসেই একে যথাযথ উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। এখানে একদিকে ধ্বংসস্তূপ, অন্যদিকে হাইরাইজ বিল্ডিং। কেউ কেউ বিলাসী জীবন যাপন করেন, আবার কেউ ত্রাণের জন্য লাইনে দাঁড়ায়। আমার মতো নিম্নমাঝারি আয়ের মানুষ শিক্ষকতা করে কোনোরকমে টিকে থাকি। আমার বাচ্চারা স্কুলে যায়, পড়ে, স্বপ্ন দেখে। ধ্বংসের মাঝেও আমরা থেমে যাইনি। প্রবাসীস্বজনদের টাকা, এনজিও ও বিদেশীদের সাহায্য আর আমাদের নিজেদের চেষ্টা— এগুলো আমাদের বাঁচিয়ে রাখে। আমি আমার শিক্ষার্থীদের বলি, “লেখাপড়া করো, এটাই তোমাদের মুক্তির পথ।”