সাদ রহমান ।।
নতুন নির্বাচন কমিশন শপথ নেওয়ার মধ্য দিয়া ইলেকশনের ট্রেন কমলাপুর স্টেশন ছাইড়া গেলো। গন্তব্য অজানা হইতে পারে, তবে ট্রেন যে ছাইড়া গেছে এই বিষয়ে কারোর মনে আর কোন দ্বিধা-আশঙ্কা রাখার সুযোগ দেখি না।
কথা হইলো, দেশের মানুষ কি সময়ের আগেই এরকম তড়িঘড়ি ট্রেনে উঠতে পাইরা খুশি?
আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক বলে, না।
এমনকি বিএনপির ভোটাররাও এই ঘটনায় খুশি হইছে কিনা তা বলা যায় না।
ঘটনাটা ঘটছে নিছক একটা ট্রেন ছাইড়া যাওয়ার মতোই। এর বাইরে এই ঘটনার আর কোন ধাক্কা কোথাও লাগে নাই।
মানুষের কাছে তো পরিষ্কারই না, নির্বাচনটা হবে কার-কার মধ্যে। ফলে ধাক্কা লাগার বাস্তব কোন কারণও দেখি না।
যেকোন ট্রেন স্টেশন ছাইড়া যাওয়াই যে আসল কথা না, এইটা নিশ্চয়ই এতোদিনে দেশের মানুষ বুঝতে পারে। বরং, গন্তব্যে তারা কতোটা ফ্যাসাদহীন ভাবে পৌঁছাইতে পারবে সেটাই আসল কথা।
এমতাবস্থায়, এই সিস্টেমে গণ্ডগোল অলা ইঞ্জিন তাদেরকে টাইনা কোথায় নিয়া যাইতে পারে, এই বিষয়ে তারা ভাবতে চাইতেছে না।
আমিও যে খুব ভাবতে চাই এমনও না। তবে বিএনপি বিএনপির কাজ করছে। এইজন্য টিভি-বুদ্ধিজীবীদের মতো আমিও বিএনপিকে সাধুবাদ জানাই।
কিছুটা মর্মান্তিকভাবে হইলেও, এটা এখন ধইরা নেওয়া ভালো যে—জুলাই বিপ্লবের ফসল আমরা একটা সুষ্ঠু, ঠাণ্ডা ও প্রতোযোগিতাহীন নির্বাচন উদযাপনের ভিতর দিয়া পাইতে যাইতেছি।
স্যাড, বাট ট্রু।
এখন এই ট্রুথ আমরা কতোটা ভাঙতে পারবো তার মধ্যেই সুপ্ত আছে আমাদের আগামী দিনের রাজনীতি।
এই অবস্থায়, জুলাই আন্দোলনের বিখ্যাত ছাত্রনেতাদেরকে একটু নিন্দা না কইরা পারা যাইতেছে না।
বৈষম্যের হাসনাত আব্দুল্লাহ, সারজিস আলম, ও জাতীয় নাগরিক কমিটির ইন্টেলেকচুয়াল ছাত্রনেতাদেরকে নিয়া এইটা মূলত একটা বিষোদগারমূলক লেখা।
প্রথমে বিষোদগার, তারপরে কিছু পরামর্শ থাকতেছে।
২.
বদিউল আলম মজুমদার সাহেব নির্বাচন সংস্কার প্রসঙ্গে অলরেডি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদেরকে দিয়া কথা বলাইয়া দেশে নির্বাচনের একটা আমেজ তৈরি করতেছেন।
বা আমেজ তৈরির দায়িত্ব পালন করতেছেন।
অন্যদিকে দেখেন, সংবিধান সংস্কার কমিশনের আলী রিয়াজ সাহেব এখন পর্যন্ত নিষ্প্রভ। আলী রিয়াজ হয়তো বুঝতে পারছেন, সংবিধান সংস্কার কমিশনের আসলে খুব বেশি কিছু করার নাই।
বিএনপি এই সরকারকে সংবিধান পুনর্লিখন তো দূরে থাক, বড়সড় কোন সংশোধনও করতে দিবে না। ফলে এইখানে পারাপারি করার অর্থ নিজের ইমেজ নষ্ট করা। আলী রিয়াজ হুদাই নিজের ইমেজ নষ্ট করবেন তা আমার মনে হয় না।
তবে তিনি যদি চেষ্টা করেন আমার মতো অনেকেই খুশি হবে।
আরেকদিকে দেখেন, গতকালকে ‘স্থানীয় সরকার কমিশনে’র প্রধান তোফায়েল আহমেদের আগমন ঘটলো।
‘জাতীয় নির্বাচনে’র আগে যেনো ‘স্থানীয় সরকার নির্বাচন’ হয়—এমন একটা বাণী তিনি সঙ্গে কইরা নিয়া আসছেন।
তার বাণীর উদ্দেশ্যটাও বোঝা গেলো। ‘স্থানীয় সরকার নির্বাচনে’র মধ্য দিয়া ‘জাতীয় নির্বাচনে’র তারিখরে যদি কোনভাবে ছাব্বিশ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত টাইনা নিয়া ঠ্যাকানো যায়, তাইলে সরকারের মধ্যে স্বস্তি আসবে।
উদ্দেশ্য ঠিক আছে, তেমনই বক্তব্যও ঠিক আছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন নির্দলীয় হওয়াই উত্তম। এবং তা আগামি জাতীয় নির্বাচনের আগেই।
কিন্তু এইসব ঘটনামালার মধ্য দিয়া যেই বিষয়টা স্পষ্ট হইতেছে তা হইলো, মানে আমার বলার বিষয় যেইটা—বিএনপি যে আসলেও সরকারকে ক্যামন চাইপা ধরতে পারছিলো, এবং তার ফলে সরকার কীরকম চাপের মধ্যে পইড়া গেছিলো, এবং এখনও চাপের মধ্যে আছে, এইটা।
সরকারের এই চাপ সহজে কাটবে বইলা মনে হয় না।
বিএনপির বড়ভাইগিরি ও সাহায্যহীনতা জুলাই-অভ্যুত্থানের সরকারকে অলরেডি একটা ‘নির্বাচনের সরকার’ বানাইয়া ফেলছে।
বড় বড় সংস্কারকদের মুখেও এখন নির্বাচন ছাড়া আর কোন আলাপ তোলাই যেনো নিষেধ।
৩.
নাও, আপনাদের কাছে আমার প্রশ্ন, বলেন তো—এই যে বিএনপির দিক থেকে মাকড়শার জাল ছড়ানোর মতো রাজনীতিটা বিএনপি করলো, এইখানে আমাদের বিপ্লবী ছাত্রনেতারা কি সরকারকে এক রত্তি সাহায্য করতে পারছে?
প্রশ্নটা ব্যাড হইলেও উত্তরটা সহজ, পারে নাই।
কিন্তু তাদেরকেই আবার আমরা ‘কিংস পার্টি’ বা ‘কিংমেকার’ ইত্যাদি বইলা বইলা ডাকতেছি। হাস্যকর।
চুপ্পু ইস্যুতে, এবং বাহাত্তোরের সংবিধান বাতিলের প্রসঙ্গে তাদের দৌড় দেইখাই আমরা পরিষ্কার হইয়া গেছিলাম তারা কী ছিঁড়তে পারবেন।
এইটা প্রফেসর ইউনূস সাহেবও তার মতো বুইঝা নিছিলেন নিশ্চয়ই।
ফলে এরপরে সরকার একপ্রকার বাধ্য হইয়াই তাদেরকে ‘সাইড’ কইরা দিছিলো। যা উপদেষ্টা পরিষদ সম্প্রসারণের সময়ে তাদেরকে পাত্তা না দিয়া সরকার স্পষ্ট করছিলো।
গত তিন মাসের ইতিহাস আমার কাছে মূলত জুলাই অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতাদের ব্যর্থতার ও রাজনীতিশূন্যতার ইতিহাস।
এইটা যতোটা না বিএনপির সফলতার তিন মাস ছিলো, তার চাইতে বেশি ছিলো ছাত্রনেতাদের ব্যর্থতার প্রমাণ।
যেই সময়ে দেশ ও দেশের নীতি-পলিসি ইত্যাদি নিয়া তাদের আলাপ-আলোচনা শুরু করার কথা, ঠিক সেই সময়েই ছাত্রনেতারা চিন্তিত হইয়া গেছিলো দেশের মেজোরিটি মুসলিম সম্প্রদায় তাদেরকে কীভাবে দেখবে এই প্রশ্নে।
ফলে, তারা হিজাব পরবে না পাঞ্জাবি পরবে, নাকি কার বউ কতো নেককার এইটা প্রচার করবে—এইসব আজাইরা ব্যস্ততায় রাজনীতি খুঁজতে শুরু করলো।
তার ধারাবাহিকতায়—আমি বলবো, পপুলিস্ট চিন্তাভাবনার পেট থেকে আসা এইসব ফাংগাল প্যাথোজেনস একদম শুরুতেই ছাত্রনেতাদেরকে ইন্টারনালি ছাবড়া কইরা দিছিলো।
যার ফল স্বরূপ, এখন তারা, প্রায় কিছুইতেই আর নাই।
৪.
৫ আগস্টের পরবর্তী দিনগুলা যদি আমরা একটু রিমেম্বার করি, তাইলে আমরা ভালোই মনে করতে পারবো বাহাত্তরের সংবিধান ফালাইয়া দেওয়ার প্রসঙ্গটা তখন কতো জোরালো ছিলো।
সংবিধানের পক্ষে একটা ছোট কথা বইলা তো শাহদীন মালিক সাহেব দুইদিনের ভিতরে বাদই পড়ছিলেন।
রূঢ় হইলেও সত্য, শক্তিশালী বিএনপি দিনে দিনে সংবিধান ফালানোর সেই আলাপটারে পটকা বানাইয়া হাওয়ায় উড়াইয়া দিছে।
এই বাস্তবতায়, বিপ্লবী ছাত্রনেতাদের প্রতি আমার প্রথম পরামর্শ থাকবে—তারা যেনো এই নতুন বাস্তবতাটাকে অনুধাবন করেন।
এই যে ‘বিএনপিময়’ বাস্তবতা, এইটা তাদেরকে মাইনা নিতে পারতে হবে। এই সময়ে আইসা তারা আবার সংবিধানের প্যাচালের মধ্যে গিয়া ঢুকলে তাদের বাকি ক্রেডিবিলিটিও তারা হারাবে।
তাদেরকে যেটা করতে হবে—একমাত্র সংস্কার কেন্দ্রিক আলাপ-আলোচনাকে পুঁজি কইরাই বিএনপির আলাপ-আলোচনাকে উৎরাইতে পারতে হবে।
সরকার কিন্তু এই মুহূর্তে সংবিধান সংস্কার প্রসঙ্গে বেশি কিছু বলার কথা ভাবতেছে না। কারণ সরকার সাহস পাইতেছে না।
ফলে সরকার নির্বাচন সংক্রান্ত কমিশনগুলোর মুখ দিয়াই শুধু সংস্কার বিষয়ে কিছু আলাপ সামনে নিয়া আসতেছে।
যেমন, নির্বাচন সংস্কারের বদিউল আলম মজুমদার সাহেব ‘রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে’র প্রস্তাব উঠাইয়া আনলেন। বা তোফায়েল আহমেদ সাহেব আইন কইরা স্থানীয় সরকারের কাজের জায়গা স্পষ্ট করার কথা বললেন।
এই অবস্থায় ছাত্রদের বুঝতে হবে যে, তারা ক্যাপাসিটি দেখাইতে পারলে তবেই সরকার আবার সংস্কার বিষয়ক আলাপ-আলোচনা সামনে আনতে পারবে।
মানে যেসব সংস্কার নির্বাচন সংশ্লিষ্ট না সেইগুলা।
ছাত্রনেতারা যদি তাদের কাজের জায়গাটা এইভাবে স্পেসিফিক করতে পারে, তাইলে তারা ঘুইরা দাঁড়াইতে পারবে। সরকারও তাদের দ্বারা উপকৃত হবে।
বিএনপির রাজনীতির আগামাথা হাড্ডিরক্ত সব গবেষণা কইরা ছাত্রদের সাজাইতে হবে—ঠিক কীভাবে আগাইলে পরে তারা বিএনপির রাজনীতির কাউন্টার দিতে পারতেছে।
মোটকথা, বিএনপির রাজনীতি কী, আর সংস্কার প্রশ্নে তাদের রাজনীতি কী—এই দুইয়ের মধ্যে ক্লিয়ার পার্থক্য রচনা করতে হবে।
৫.
আমি বিএনপিকে অপছন্দ করি বিষয়টা এমন না।
আমি একরকম বিএনপি পরিবার থেকে আসা মানুষ। আমার চাচা বিএনপির রাজনীতি কইরা রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হইছিলেন।
অনেক শৈশবে, একবার আমাদের বাসায় মির্জা আব্বাস সাহেবও আসছিলেন। যেহেতু আমার চাচা তার সঙ্গে রাজনীতি করতেন। সেইসব দিনের কথা মনে আছে।
ফলে আমি বিএনপি-বিরোধী রাজনীতিতে জাতিকে উদ্বুদ্ধ করতেছি ব্যাপারটা তা না।
আমি মূলত বিএনপির রাজনীতির কাউন্টার রাজনীতি তৈরির আবেদন করতেছি, তার কারণ, এটা ছাড়া আমরা আসলে কখনোই গণতন্ত্র পর্যন্ত পৌঁছাইতে পারবো না।
সেকারণেই—আমাদের একমাত্র লক্ষ্য সুষ্ঠু নির্বাচন না, বরং নির্বাচনের মধ্য দিয়া আমরা কী কী অপশন ডিল করতেছি সেইগুলা আবিষ্কার করা।
আর তার মধ্য দিয়া একটা ফ্রুটফুল গণতান্ত্রিক সংলাপে প্রবেশ করা।
ছাত্রনেতারা দলগঠন করতে যাইতেছেন এইটা ভালো কথা। কিন্তু রাজনীতিহীন হুদাই একটা দল আমাদেরকে কিছুই দিবে না।
ছাত্রদেরকে খেয়াল রাখতে হবে, মির্জা ফখরুল আলমগীর সাহেবও কিন্তু চাইতেছেন, ছাত্ররা দল করুক।
কারণ দল করা জিনিসটা যে ক্যামন কঠিন, এটা বুঝতে পাইরা ছাত্ররা যেনো নিজেদেরকে খুব বেশি কিছু না ভাবে এইটা আলমগীর সাহেবের চাওয়া।
আলমগীর সাহেবের চাওয়ার বাইরেও ছাত্রদেরকে কিছু করতে পারতে হবে। দলগঠনে গুরুত্ব কম দিয়া বরং আলাপ বা বক্তব্য তৈরিতে মনোনিবেশ করতে হবে।
এবং মানুষের বোধগম্য আলাপ-আলোচনা তৈরির মধ্য দিয়া সমাজে জনপ্রিয়তা উৎপাদন করতে হবে।
আর যদি রাজনৈতিক ভাবে জনপ্রিয়তা উৎপাদন করা যায়, তাইলে দলগঠন কঠিন কিছু হবে না। তখন চাঁদা তোলাও সহজ হইয়া যাবে।
৬.
হাসনাত এবং সারজিস আলমরা কিছুদিন আগে একটা আলাপ তুলছিলেন, সব অঞ্চল থেকে ক্যানো সমানভাবে উপদেষ্টা নেওয়া হইতেছে না।
আমার তাদের কাছে জানতে মনে চায়, তারা এইটুকু আলাপ যদি করতে পারছিলেন, তাইলে আরেকটু আগাইয়া ক্যানো ‘ফেডারেল সরকার ব্যবস্থা’র আলাপটা উঠাইতে পারলেন না?
ক্যানো সবসময়ই ছোট ছোট তুচ্ছ আলাপই তাদের করতে হয়? বড় আলাপ করার সাহস তারা পান না ক্যানো? নাকি তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না?
বাংলাদেশে ৮ টা আলাদা বিভাগ আছে।
এই আট বিভাগরে আলাদা আলাদা প্রদেশ বা রাজ্য বানাইয়া আমরা আমরা ‘ফেডারেল সরকার ব্যবস্থা’য় প্রবেশ করতেই পারি।
একটা বিশ কোটি মানুষের দেশ চালানোর জন্য কয়েকটা সচিবালয়ের বিল্ডিং আদৌ বাস্তব কোন আইডিয়া কি?
আমরা সবাই বিকেন্দ্রিকরণের কথা বলি, কিন্তু অদ্ভুত কোন কারণে ‘ফেডারেল ব্যবস্থা’র কথা বলতে ভয় পাই। কিন্তু আজ না হোক কাল আমাদেরকে এই ব্যবস্থায় প্রবেশ করতে হবেই।
পাঁচ আগস্টের পরে সম্ভবত বিগ্রেডিয়ার সাখাওয়াতই একবার এই আলাপটা তুলছিলেন। অথচ এইটা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সবচেয়ে ভাইটাল প্রশ্ন হওয়ার কথা ছিলো জুলাই-অভ্যুত্থানের পরে।
আমি মনে করি, ছাত্রনেতারা ‘ফেডালের সরকার ব্যবস্থা’র দাবি জোরালোভাবে সামনে আনতে পারে।
একটা বিষয় আমাদের মাথায় রাখতে হবে, বিএনপি-আওয়ামীলীগ এরা চায় না ‘ফেডারেল সরকার ব্যবস্থা’। তার কারণ, ক্ষমতাকে বিকেন্দ্রিত কইরা তারা ঝুঁকিতে পড়তে চায় না।
রংপুরের কোন এক মমতা ব্যানার্জী দিনরাত তাদেরকে দৌড়ের উপরে রাখবে, এমনটা তাদের চাওয়ার কথাও না। কিন্তু আমাদের নাগরিকদের তো এমনই চাওয়ার কথা তাই না?
ক্যানো আমরা ক্ষমতাকে এতো শান্তিতে থাকতে দিবো?
ঠাকুরগাঁওয়ের মির্জা ফখরুল আলমগীর গুলশানে আইসা রাজনীতি করলে আমাদের পাওয়ার মতো জিনিস আসলে কইমা যায়। এইটা আমাদের বুঝতে হবে।
বরং ঠাকুরগাঁওয়ের আলমগীর ঠাকুরগাঁওয়ে থাকতে পারলেই আমরা তখন ঢাকাকে দৌড়ের উপরে রাখতে পারবো।
বিপ্লবী ছাত্রনেতারা যেনো এইটা বুঝে। জাতীয় নির্বাচনে তারা একসঙ্গে সারা দেশ কভার করতে পারবে না। কিন্তু রাজ্য নির্ধারণ কইরা আস্তে আস্তে আগাইলে তারা রাজ্য-নির্বাচনগুলা দিয়া উইঠা আসতে পারবে।
কোন রাজ্যে একবার জিতলে তখন থেকেই কেন্দ্রীয় সরকারকে টাইটে রাখা শুরু হবে।
অর্থাৎ নবীন দল হিসাবেও ‘ফেডারেল সরকার ব্যবস্থা’ তাদের জন্য বাস্তবসম্মত রাজনীতির পথ উন্মুক্ত কইরা দিবে।
৭.
‘স্থানীয় সরকার’ জিনিসটা একেবারেই স্পষ্ট কিছু না। এইটা দেশের ৭০ ভাগ অঞ্চলকে শোষণের হাতিয়ার।
স্থানীয় সরকারের অধীনে থাকা নাগরিকেরা যেই ট্যাক্স দেয়, সেই ট্যাক্সের সুবিধা তাদের কাছে ফেরত যায় না। এইটা সহজ হিসাব।
ফলে ট্যাক্সের টাকা দেওয়ার পরে তার সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য আমাদেরকে স্থানীয় সরকারের পাশাপাশি ফেডারেল ব্যবস্থায় যাইতে হবে।
জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী সাংসদদের কাজ তো আইন প্রণয়নের, রাইট? নিজ এলাকার নামে যদি কোন বিল পাশ করা যায়, সেইটা তাদের একটা কনসার্নের জায়গা, কিন্তু সেইটা তো মূলকাজের বিষয় না।
কিন্তু ‘স্থানীয় সরকার’ শক্তিশালী না হওয়ায় তারা নিজ নিজ এলাকায় ‘উন্নয়ন-কন্ট্রাক্টরে’র রোল প্লে করতে থাকে।
আর মানুষও ভাবে, এলাকার রাস্তাঘাট বানাইয়া দিবেন তার এমপি।
আইন প্রণেতা ক্যানো রাস্তাঘাট বানানোর কাজ করবে, এইটা না জানে মানুষ, না জানে সাংসদ নিজে।
খুব অল্প ঘিলু খাটাইলেই আমরা বুঝতে পারবো, ‘স্থানীয় সরকার’ জিনিসটাকে ব্যবহার কইরা দেশের মানুষের উপরে সবচেয়ে বড় অসাংবিধানিক স্বেচ্ছাচার চলে।
আমি লেইখা দিতে পারি, ‘স্থানীয় সরকার’ কখনোই সবল হবে না। বিএনপি আসুক আর যেই আসুক, ‘কেন্দ্রীয়’ ঢাকার সামনে আইসা এই ‘স্থানীয়’ দাঁড়াইতে পারবে না।
কাজেই রাজ্য বা প্রদেশ সরকার গঠনের মধ্য দিয়া ‘ফেডারেল সিস্টেমে’ আমাদেরকে ঢুকতে হবে।
যেহেতু তাতে ট্যাক্সের টাকা রাজ্যের মধ্যেই আয় হইয়া সেইখানেই ব্যয় হইতে পারবে। এবং মানুষকে লঞ্চ-বাস-পদ্মা সেতু ইত্যাদি পার হইয়া ঢাকায় আসতে হবে না।
আরেকটা বিষয়ও আমাদের মাথায় রাখতে হবে, ক্ষমতার চেক ব্যালেন্সও কখনোই দ্বি-কক্ষ পার্লামেন্ট বানাইয়া নিশ্চিত করা যাবে না। কারণ বাংলাদেশ আর আমেরিকা একরকম না।
একমাত্র ‘ফেডারেল ব্যবস্থা’ দিয়াই এই চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স আনা সম্ভব।
যেহেতু তাতে অনেকগুলা আঞ্চলিক প্রশাসন ও অনেকগুলা নিজস্ব রাজস্বনীতি থাকবে। উইদাউট নিজের মানি এবং নিজের আইন—কেন্দ্রাঞ্চলের সঙ্গে ফাইট করা একটা অবাস্তব ব্যাপার।
আমি ‘প্রেসিডেন্ট নির্বাচন’ চাই। যা অলরেডি বদিউল আলম মজুমদার সাহেবদের আলাপে উইঠা আসছে।
এবং চাই ফেডারেল সরকার ব্যবস্থা। যেই আলাপ আমি তুললাম। দুই কক্ষের পার্লামেন্ট আমি চাই না, যেহেতু সেটা দিয়া কিছু হবে না।
৮.
বিপ্লবী ছাত্ররা আমার আলাপ কানে তুলবেন কিনা তা গডের ইচ্ছার হাতে থাকলো। তবে আমি ছোট কইরা তাদেরকে আরো দুইটা পরামর্শ দিয়া এই লেখা শেষ করবো।
একটা বিদেশ নীতি সম্পর্কে, অন্যটা বিএনপি-বিরোধী ন্যারেটিভ নির্মাণ প্রসঙ্গে।
আগে বিএনপির প্রসঙ্গে বলি।
বিএনপির যেই ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ বস্তুটা আছে, এইটা মানুষের অধিকারের প্রশ্ন, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, অন্যান্য জাতিসত্ত্বার পশ্ন—এইসব বিষয়কে ওভারলুক কইরা যায়। বাঙালি সহ সকল এথনিক-ইনডিজিনিয়াস জাতিসত্ত্বার গলায় ‘বাংলাদেশি’ নামের একটা পাসপোর্ট ধরনের পরিচয় পরাইয়া দেয়।
এর কোন গভীর রাজনীতি নাই।
এইটার অপজিটে বিপ্লবী ছাত্রনেতারা ‘অধিকারভিত্তিক জাতীয়তাবাদে’র আইডিয়াকে জোরালো কইরা তুলতে পারেন।
যদি অধিকারই না থাকে, তাইলে জাতীয়তাবাদ ধুইয়া পানি খাবো আমরা?
আমাদের ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদ’ দিয়া কী কাজ, আর ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ দিয়াই বা কী কাজ?
এইভাবে সহজ কইরা বললে মানুষ ‘অধিকারভিত্তিক জাতীয়তাবাদে’র রাজনীতিটা বুঝবে।
দ্বিতীয়ত, বিদেশনীতি প্রসঙ্গে বলবো—ভারতবিরোধী হাউকাউ না কইরা প্রফেসর ইউনূস সার্ক পুনরুজ্জীবনের যেই রাজনীতি অলরেডি তৈরি কইরা দিছেন, এইটাকে তাদের আগাইয়া নিয়া যাইতে হবে।
এইক্ষেত্রে, ভারত বাদে অন্যান্য সার্কভুক্ত দেশগুলার রাজনৈতিক দল, থিংক ট্যাংক, ডায়লগ কোম্পানি ও বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে তারা ওপেন আলাপ-আলোচনা শুরু করতে পারে।
দেশের সীমানা পার কইরা, এবং তাদেরকে বাংলাদেশে নিয়া আইসা।
আমি মনে করি, এই আলাপে তারা প্রাথমিক মুন্সিয়ানা দেখাইতে পারলে, শীঘ্রই তারা চীন ও আমেরিকা এই দুই দেশে গিয়া আরো বড় পরিসরে ভারতের হেজিমনির সমস্যা নিয়া কথাবার্তা শুরু করতে পারবে।
ভারতের জন্য তার পরিণতি হবে কঠিন।
জুলাইয়ের বিপ্লবী ছাত্রনেতাদেরকে আমি বন্ধু মনে করি। বন্ধু হিসাবেই তাদেরকে এই তিনটা পরামর্শ দিলাম।
ফেডারেল ব্যবস্থা, অধিকারভিত্তিক জাতীয়তাবাদ ও সার্ক পুনরুজ্জীবন, অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত-সমস্যার আন্তর্জাতিক প্রচারণা।
গড যেনো তাদের কানে আমার এইসব কথা পৌঁছান।