সৈয়দ হাসসান ।।
বৃটিশ পার্লামেন্টের এমপি এবং সাবেক সিটি মিনিস্টার টিউলিপ সিদ্দিকের একটি সাম্প্রতিক টুইট বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। তিনি সরাসরি বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে উদ্দেশ করে বলেন:
“আমি কোনো অন্যায় করিনি এবং আমার গোপন করার কিছু নেই। আপনি যদি সত্য জানার ব্যাপারে আন্তরিক হন, তাহলে পার্লামেন্টে এসে আমার সঙ্গে দেখা করুন—আসুন কথা বলি।”
প্রথমে মনে হতে পারে এটি একটি ব্যক্তিগত আহ্বান। কিন্তু একজন সাবেক মন্ত্রীর এই বক্তব্য কূটনৈতিক চর্চায় কতটা গ্রহণযোগ্য—তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। বিশেষত, এটি যখন একজন স্বাধীন দেশের প্রধান উপদেষ্টার প্রতি প্রকাশ্য বক্তব্য, এবং বিচারাধীন বিষয় নিয়ে বলা হয়েছে, তখন এর কূটনৈতিক অভিঘাত এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব।
টিউলিপ সিদ্দিক ইতিমধ্যেই নিজের বিরুদ্ধে ওঠা নানা অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে। শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠদের কাছ থেকে উপহার হিসেবে ফ্ল্যাট নেওয়া, সাংবাদিককে হুমকি, রূপপুর প্রকল্প থেকে সুবিধা গ্রহণসহ বেশ কিছু অভিযোগ তাঁকে ঘিরে রয়েছে। এসবের প্রেক্ষিতে গত ১৪ জানুয়ারি তিনি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন। যদিও পদত্যাগপত্রে তিনি জোর দিয়ে বলেন,
“তদন্তে প্রমাণ পাওয়া যায়নি যে আমি মিনিস্ট্রিয়াল কোড ভঙ্গ করেছি। বরং আমি স্বচ্ছতার স্বার্থেই সরে দাঁড়ালাম।”
তিনি এ-ও জানান, শেখ হাসিনা তাঁর খালা এবং এটি তিনি মন্ত্রী হওয়ার আগেই যথাযথভাবে প্রকাশ করেছিলেন।
টিউলিপের টুইট কেবল তার বক্তব্য নয়, বরং তা হয়ে দাঁড়িয়েছে পশ্চিমা রাজনীতির মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের এক বিরল দৃষ্টান্ত। ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোম্যাটিক রিলেশনস অনুযায়ী, কোনো দেশের রাষ্ট্রপ্রধান বা শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, এবং অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করাই কূটনৈতিক শিষ্টাচারের মৌলনীতি।
অতএব, টিউলিপের টুইটটি তাঁর সাবেক মন্ত্রিত্ব ও বর্তমান এমপি পরিচয়ের কারণে নিছক ব্যক্তিগত নয়, বরং সেটিকে রাষ্ট্রীয় গুরুত্ব দিয়ে বিশ্লেষণ করছে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মহল।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান দাবি করেছে, অধ্যাপক ইউনূসের লন্ডন সফরের সময় তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চিঠি দিয়েছেন টিউলিপ। চিঠিতে তিনি বলেন,
“বাংলাদেশে আমার কোনো ব্যবসায়িক স্বার্থ নেই। এই দেশে আমি জন্মাইনি, থাকিনি বা পেশাগত জীবন গড়ে তুলি নাই। কিন্তু আমার হৃদয়ের টান আছে।”
তিনি আরও দাবি করেন, দুদক বারবার ঢাকার এক ঠিকানায় এলোমেলোভাবে চিঠি পাঠাচ্ছে, অথচ তাঁর আইনজীবীদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করা হচ্ছে না।
কিন্তু অধ্যাপক ইউনূসের প্রেস সচিব শফিকুল আলম সাফ জানিয়ে দিয়েছেন,
“আমরা টিউলিপ সিদ্দিকের কোনো চিঠি পাইনি।”
এই বিবৃতির পর গার্ডিয়ান–এর প্রতিবেদনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
টিউলিপ নিজেকে একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচারের শিকার দাবি করেছেন। তিনি বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ চলছে, তা শেখ হাসিনা-বিরোধীদের সাজানো। গত মাসে তাঁর বিরুদ্ধে বাংলাদেশে পরোয়ানা জারি হলেও তিনি কোনো আনুষ্ঠানিক নোটিশ পাননি বলেও দাবি করেছেন।
অধ্যাপক ইউনূস বর্তমানে ব্রিটিশ সফরে রয়েছেন। এই সফরে তিনি যুক্তরাজ্যের রাজা তৃতীয় চার্লস, প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার এবং পররাষ্ট্রসচিব ডেভিড ল্যামিসহ একাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। বাংলাদেশের একজন প্রধান উপদেষ্টার এমন সফর সাধারণত কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করবার উদ্দেশ্যেই হয়ে থাকে। কিন্তু এমন মুহূর্তে একজন ব্রিটিশ এমপির সরাসরি ‘পার্লামেন্টে এসে দেখা করুন’ মন্তব্য—তা উল্টো কূটনৈতিক উত্তেজনার আশঙ্কাই বাড়িয়ে তুলেছে।
টিউলিপ সিদ্দিকের টুইট এবং তথাকথিত চিঠি—দুটোই একই প্রশ্নের দিকে ইঙ্গিত করে: একজন পশ্চিমা রাজনীতিক কতটা মাত্রায় অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অংশ নিতে পারেন? কূটনৈতিক সৌজন্য, রাজনৈতিক শালীনতা ও আইনগত কাঠামো—সবকিছুর সমন্বয়ে উত্তর খুঁজলে এটাই প্রতীয়মান হয়, বিষয়টি নিছক ভুল–বোঝাবুঝির নয়, বরং বড় কোনো কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক সংঘাতের পূর্বাভাসও হতে পারে।
বিশেষ করে যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, সেই অধ্যাপক ইউনূস বিশ্বের সবচেয়ে স্বীকৃত নোবেলজয়ী একজন অর্থনীতিবিদ এবং বর্তমানে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা—তাঁর সঙ্গে এমন আচরণ আন্তর্জাতিক মঞ্চে টিউলিপ সিদ্দিক ও যুক্তরাজ্য উভয়ের জন্য অস্বস্তিকর অবস্থান তৈরি করতে পারে।