মুজিব মাশাল, নিউইয়র্ক টাইমস ।।
গত সপ্তাহে কাশ্মীরে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পর, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিশ্বের এক ডজনেরও বেশি নেতার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন। দিল্লিতে অবস্থিত ১০০টি মিশনের কূটনীতিকরাও বৈঠকে যোগ দিয়েছেন বলে সরকারি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
তবে এই প্রচেষ্টা মূলত পাকিস্তানের সঙ্গে উত্তেজনা কমানোর সহায়তা চাইতে নয়, বরং, চারজন কূটনৈতিক কর্মকর্তার মতে, ভারত তার প্রতিবেশী এবং চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপের ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে। পাকিস্তানের নাম না করেই, মোদি বৃহস্পতিবার এক বক্তৃতায় কঠোর শাস্তি এবং সন্ত্রাসী ঘাঁটি ধ্বংসের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
পরিস্থিতি কতটা উত্তপ্ত তা বোঝাতে, দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী মাঝেমধ্যে গুলি বিনিময় করছে বলে রোববার ভারতীয় কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। একজন কর্মকর্তা বলছেন, গত তিন রাতের মধ্যে দু’দিন গুলি বিনিময় হয়েছে; আরেক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, টানা তিন রাত গুলি বিনিময় হয়েছে।
কাশ্মীরে ভারতীয় বাহিনী ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করেছে, শত শত মানুষকে গ্রেফতার করা হচ্ছে এবং হামলাকারীদের খোঁজ চলছে।
এর আগে ভারত পাকিস্তানে পানি সরবরাহ বাধাগ্রস্ত করার ঘোষণা দেয়, যেহেতু পাকিস্তানের সেচব্যবস্থা মূলত উজানের নদীগুলোর ওপর নির্ভরশীল। ভারত পাকিস্তানের দূতাবাসের কিছু কর্মী এবং ভারত ভ্রমণরত পাকিস্তানি নাগরিকদের অবিলম্বে ভারত ছাড়ার নির্দেশও দিয়েছে।
অন্যদিকে, পাকিস্তান বলেছে তারা দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক চুক্তিগুলো থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেবে, যার মধ্যে কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ রেখা (লাইন অব কন্ট্রোল) সম্পর্কিত চুক্তিও আছে যেখানে কয়েক বছর ধরে যুদ্ধবিরতি চলছিল।
ভারতে মুসলিমবিরোধী মনোভাবও তীব্রতর হচ্ছে। অন্যান্য শহরে অধ্যয়নরত কাশ্মীরি শিক্ষার্থীরা ব্যাপক হয়রানির মুখে পড়ছে এবং অনেকেই ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছে।
সন্ত্রাসী হামলার পাঁচ দিন পরও, যাতে ২৬ জন বেসামরিক নিহত হন, ভারত কোনো গোষ্ঠীকে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়ী করেনি এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অভিযোগের পক্ষে দৃঢ় প্রমাণও প্রকাশ করেনি। পাকিস্তান সরকার হামলার সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেছে।
কূটনৈতিকদের দেওয়া ব্রিফিংয়ে ভারতীয় কর্মকর্তারা অতীতে পাকিস্তানের সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সমর্থনের ইতিহাস বর্ণনা করেছেন। তদন্ত চলছে বলেও তারা জানিয়েছেন এবং হামলাকারীদের পাকিস্তানের সঙ্গে সংযোগের টেকনিক্যাল ইন্টেলিজেন্স (যেমন ফেসিয়াল রিকগনিশন) সংক্ষেপে উল্লেখ করেছেন।
বিশ্লেষক ও কূটনীতিকদের মতে, এখন পর্যন্ত দৃঢ় প্রমাণ না দেওয়ার অর্থ হতে পারে দুটি বিষয়: হয় ভারত আরও তথ্য সংগ্রহের জন্য সময় নিচ্ছে, অথবা বৈশ্বিক অস্থিরতার সময়ে তারা মনে করছে যে, কারো কাছে হিসাব দেওয়া ছাড়াই পদক্ষেপ নেওয়া যাবে।
ভারত ও পাকিস্তান দু’দেশই পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত। সামরিক সংঘাত দ্রুত বড় আকার নিতে পারে। তবে ভারতের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ তেমন একটা নেই। বরং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতের কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি বাড়ায় দেশটি আগের তুলনায় সাহসী হয়েছে।
ইরান ও সৌদি আরব উভয় পক্ষের সঙ্গে কথা বলেছে। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মধ্যস্থতার প্রস্তাবও দিয়েছেন। জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সংযম ও সংলাপের আহ্বান জানিয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রসহ বড় শক্তিগুলো অন্য সংকটে ব্যস্ত, ফলে বিশ্লেষকরা বলছেন, অনেক দেশের ন্যায়বিচারের পক্ষে সমর্থনকেই ভারত নিজেদের পদক্ষেপের জন্য সবুজ সংকেত হিসেবে দেখছে।
ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তারা ভারতের সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইকে শক্ত সমর্থন জানিয়েছেন। ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের বন্ধু, যদিও উভয়ের মধ্যে দীর্ঘদিনের বিরোধ রয়েছে।
তবে ওয়াশিংটন কীভাবে এই সংঘর্ষে ভূমিকা রাখবে তা এখনো স্পষ্ট নয়। ট্রাম্প প্রশাসন তখনো ভারতের জন্য কোনো রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করেনি, যা দক্ষিণ এশিয়ার অগ্রাধিকার কম থাকার ইঙ্গিত দেয়।
এমনকি যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো শক্তি মধ্যস্থতার চেষ্টা করলেও, তাদের প্রভাব সীমিত হতে পারে। ভারত ও পাকিস্তান কাশ্মীর নিয়ে একাধিক যুদ্ধ করেছে। দিল্লি এই ইস্যুকে কেবল পাকিস্তানের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বিষয় হিসেবে দেখে।
জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড্যানিয়েল মার্কি বলেছেন, ২০১৯ সালে কাশ্মীরে জইশ-ই-মুহাম্মদ গোষ্ঠীর হামলার পর ট্রাম্প প্রশাসন ভারতের প্রতি সমর্থন দেখিয়েছিল। ভারত তখন পাকিস্তানে বিমান হামলা করেছিল, যদিও ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা নিয়ে মতবিরোধ ছিল।
পাকিস্তান পাল্টা হামলা চালিয়ে একটি ভারতীয় জেট ভূপাতিত করেছিল এবং পাইলটকে বন্দি করেছিল। এবার ভারত আরও ‘চমকপ্রদ’ কিছু করার পরিকল্পনা করছে বলেই সব সংকেত মিলছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। পাকিস্তানও পাল্টা পাল্টা হামলার হুমকি দিয়েছে।
মার্কি বলেন, “টিট ফর ট্যাট দ্রুত গতি পেতে পারে এবং উভয় দেশই নিজেদের সক্ষমতা নিয়ে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী।”
গত সপ্তাহের হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার নিয়েও ধোঁয়াশা রয়েছে। হামলাকারীদের সঠিক সংখ্যা নিশ্চিত নয়। “দ্য রেসিস্ট্যান্স ফ্রন্ট” নামে একটি অল্প পরিচিত গোষ্ঠী সামাজিক মাধ্যমে দায় স্বীকার করেছে বলে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে। ভারতীয় কর্মকর্তারা বলছেন, এটি মূলত পাকিস্তানভিত্তিক লস্কর-ই-তৈয়বা সংগঠনের ছদ্মবেশী শাখা।
এই অনিশ্চয়তার কারণেই ভারত এখন পাকিস্তানের অতীতের সন্ত্রাসী সমর্থনের ইতিহাস তুলে ধরছে, যদিও প্রমাণ প্রকাশের আগেই সামরিক পদক্ষেপের প্রস্তুতি কিছু কূটনীতিককে প্রশ্ন তুলতে বাধ্য করছে: “কেবল অতীতের ইতিহাসের ওপর ভিত্তি করে কি পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত প্রতিবেশীর সঙ্গে যুদ্ধ করা উচিত?”
ভারতের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন বলেছেন, মোদির পক্ষে এখন সামরিক পদক্ষেপ ছাড়া বিকল্প কম। ২০১৬ ও ২০১৯ সালে কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলার পরও ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নিয়েছিল।
তবে মেনন মনে করেন, এই পাল্টাপাল্টি প্রতিক্রিয়া সীমিত থাকবে।
তিনি বলেন, “আমি খুব বেশি উদ্বিগ্ন নই, কারণ উভয় পক্ষই ‘পরিচালিত বৈরিতার’ অবস্থায় খুশি।”
ভাষান্তর : সবজান্তা সমশের