সৈয়দ মূসা গারদেজি ।।
এটি এমন একটি প্রশ্ন যা সময়ে সময়ে বসার ঘর, বক্তৃতা হল এবং সাহিত্য উৎসবগুলোতে উঠে আসে। আর এর বেশ প্রচলিত একটি উত্তরও আছে—হ্যাঁ, কবিতা হয় মৃত নয়তো দ্রুত মৃত্যুর পথে।
অনেকেই বলেন, তরুণরা এখন কম পড়ছে, তারা কবিতার সূক্ষ্মতা ও শৈলী নিয়ে গভীর অধ্যয়ন করছে না, শিক্ষা ব্যবস্থায় মানবিক শাখাকে আগের মতো গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না, আর সামাজিক ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো আর শিল্প-সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতায় আগ্রহী নয়।
এছাড়া, সমকালীন সাহিত্য জগতে আর এমন কেউ নেই যিনি আগের শতাব্দীর মহান কবিদের মতো কালজয়ী হতে পারেন। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন—”আমাদের সময়ের ফয়েজ, রশীদ, বা জোশ কে?”
এসব কারণ মিলিয়ে অনেকে কবিতাকে মৃত্যুশয্যায় শায়িত বলে মনে করেন।
কিন্তু একজন তরুণ হিসেবে করাচিতে আমি এমন অনেক পরিবেশে থেকেছি যেখানে “তীব্র কবিতার আবহ” বিদ্যমান, যা এই প্রচলিত ধারণার বিরোধিতা করে।
করাচির ঐতিহ্যবাহী মুশায়েরা
যেমন, আমি সম্প্রতি করাচির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক উৎসব ‘সাকিনান-এ-শহর-এ-কায়েদ’ আলমি মুশায়েরাতে অংশ নিয়েছিলাম, যা প্রতি বছর ৪ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়। এতে উর্দুভাষী বিশ্ব থেকে পঞ্চাশজন কবি অংশ নেন। প্রচলিত রীতি অনুযায়ী, এটি শুরু হয় রাত ১০টায় এবং চলে পরদিন ভোর পর্যন্ত।
এই মুশায়েরার পরিবেশ সত্যিই এক উৎসবের মতো। একটি মৃতপ্রায় শিল্পের জন্য এমন আয়োজন সম্ভব হতো না।
প্রথমত, এর বিশাল পরিসরই কবিতার শক্তিমত্তার প্রমাণ। প্রতি বছর এখানে ১০-১৫ হাজার দর্শক সমবেত হন। ইংরেজি ভাষাভাষী বিশ্বে যেখানে পুলিৎজার পুরস্কার বিজয়ী কবিরাও ছোট হলরুম পূর্ণ করতে হিমশিম খান, সেখানে উর্দু কবিতার জন্য এত বিশাল উপস্থিতি সত্যিই প্রশংসনীয়।
শুধু দর্শকের সংখ্যাই নয়, বরং তাদের আবেগপূর্ণ অংশগ্রহণও বিস্ময়কর।
প্রথাগত দাদ দেওয়া ছাড়াও দর্শকরা হাততালি ও উল্লাসে কবিতার প্রতি তাদের ভালোবাসা প্রকাশ করছিল। সাহিত্য ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের পাশাপাশি তরুণদের সক্রিয় উপস্থিতি বিশেষভাবে লক্ষণীয় ছিল।
নস্টালজিকরা হয়তো ৮০’র দশকের সেই সময়ের কথা মনে করতে পারেন, যখন এই মুশায়রা করাচির জাতীয় স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হতো এবং ৪০,০০০ লোকের উপস্থিতি থাকত। তাতে ভারতীয় কবিরাও অংশ নিতেন, যেমন—কৈফি আজমি ও মাজরুহ সুলতানপুরী।
কিন্তু অতীতের স্মৃতিচারণা আমাদের বর্তমানের সৌন্দর্য বুঝতে বাধা দিতে পারে না। এই মুশায়রার মতো কবিতার আসর পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই অনুষ্ঠিত হয়। এবং এগুলো কেবল শিক্ষিত উচ্চবিত্তদের জন্য নয়; বরং সাধারণ মানুষের সাংস্কৃতিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
বিজ্ঞাপনে কবিতা
কবিতার উপস্থিতি শুধু সাহিত্য জগতেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি বাণিজ্যিক ক্ষেত্রেও প্রবলভাবে বিদ্যমান।
সম্প্রতি পাকিস্তানের একটি বিস্কুট ব্র্যান্ড এমন এক ক্যাম্পেইন চালিয়েছিল, যেখানে তারা আল্লামা ইকবাল, মির্জা গালিব, জিগর মুরাদাবাদি ও মুস্তাফা জায়েদির কবিতা বিস্কুটের বাক্সে ছেপেছিল। তাদের ছবি ও কবিতার পঙক্তি শহরের বড় বড় বিলবোর্ডেও দেখা গিয়েছিল।
একটি রাইড-হেলিং কোম্পানি মুনির নিয়াজীর জনপ্রিয় পঙক্তি—“হামেশা দের কর দেতা হুঁ ম্যায়”—ব্যবহার করেছিল তাদের বিজ্ঞাপনে, যা ছিল এক মজার প্রতীকী ব্যঙ্গ।
এছাড়া, জনপ্রিয় পানীয় কোম্পানিগুলোও তাদের বিজ্ঞাপনে ক্লাসিক্যাল উর্দু কবিতাকে সুরে সুরে উপস্থাপন করছে।
এর অর্থ একটাই—এই সমাজে কবিতা এতটাই জনপ্রিয় যে ব্যবসায়ীরাও তাদের পণ্য বিক্রি করতে গালিব বা ইকবালের কবিতার সাহায্য নেন।
রাজনীতি ও সামাজিক মাধ্যমে কবিতা
সংসদের অধিবেশনগুলোতে রাজনীতিবিদরা প্রায়ই কবিতার পঙক্তি উদ্ধৃত করেন। জনসভায়ও ফয়েজ আহমদ ফয়েজ বা হাবীব জালিবের কবিতা আবৃত্তি করতে শোনা যায়।
টিকটক ও ইনস্টাগ্রামে “শায়রি মিম” খুবই জনপ্রিয়। তরুণরা আহমদ ফারাজ ও জাউন এলিয়ার কবিতাকে তাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে মিশিয়ে মজার উপস্থাপন করছে।
পশ্চিমা সমাজে যেখানে কবিতা ব্যক্তিগত অনুভূতির দিকে ঝুঁকেছে, সেখানে আমাদের অঞ্চলের কবিতা এখনও সামাজিক ও রাজনৈতিক চেতনার প্রতিফলন ঘটায়।
ধর্মীয় ক্ষেত্রে কবিতা
পাকিস্তানের ধর্মীয় সংস্কৃতিতেও কবিতার শক্তিশালী উপস্থিতি রয়েছে।
আহমদ রেজা খানের লেখা নাত, মির আনিস ও মির্জা দবিরের মর্সিয়া, এবং কাওয়ালদের পরিবেশিত সুফি কবিতা লাখো মানুষের আত্মার খোরাক জুগিয়ে চলেছে।
একটি সমাজ যেখানে মানুষ তাদের গভীরতম আবেগ ও ধর্মীয় অনুভূতি প্রকাশের জন্য কবিতার আশ্রয় নেয়, তাকে কীভাবে কবিতার মৃত সমাজ বলা যায়?
কবিতার ভবিষ্যৎ
যদিও তরুণরা উর্দু, ফারসি ও আরবি কবিতার প্রকৃত সৌন্দর্য পুরোপুরি বুঝতে পারে না, তবু তাদের মধ্যে কবিতার প্রতি আগ্রহ প্রবল।
বিশিষ্ট পণ্ডিত ড. নোমান উল হক বলেছেন, ভাষা হারানো আমাদের সাংস্কৃতিক আত্মার এক বড় ক্ষতি। তবে, যদি তরুণ প্রজন্ম ভাষা ও কবিতার শৈলী শেখার সুযোগ পায়, তবে তারা চমৎকার সাহিত্য রচনা করতে সক্ষম হবে।
কেউ কেউ জিজ্ঞাসা করেন, “আজকের যুগের গালিব, ইকবাল বা মির কে?”
এর উত্তরে উর্দু সাহিত্যের জীবন্ত কিংবদন্তি জেহরা নিগাহ বলেছেন—”উর্দু কবিতার ‘মহানতা’র সিংহাসন দীর্ঘ সময় খালি থাকে, যতক্ষণ না শতাব্দীতে একবার কেউ মির বা গালিবের মতো এসে তা অধিকার করে।”
উপসংহার
সুতরাং, কবিতা মৃত কি না, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চাইলে আমাদের তাকাতে হবে সেই অসংখ্য মুশায়রা, বিলবোর্ড, বিজ্ঞাপন, রাজনীতি, মিম ও ধর্মীয় উৎসবগুলোর দিকে—যেখানে প্রতিনিয়ত কবিতা বেঁচে আছে, শ্বাস নিচ্ছে, এবং নতুন নতুন রূপে আত্মপ্রকাশ করছে।
হয়তো আমাদের মাঝেই রয়েছেন সেই নতুন গালিব বা ইকবাল, যিনি একদিন উঠে এসে আমাদের যুগের কণ্ঠস্বর হবেন।
লেখক, পাকিস্তানের ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউনের মূল লেখাটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন সবজান্তা সমশের।