হামীম কেফায়েত ।।
কোটাবিরোধী আন্দোলনে আমি সবসময় বিরক্ত ছিলাম। দুইদিন পরপর রাস্তাঘাট বন্ধ, হট্টগোলা আমার ভালোই লাগতো না। কিছু মানুষের ব্যক্তিগত প্রাপ্তি ও প্রত্যাশার চিৎকার ভালো শোনা যাওয়ার কথা নয়। জীবনে কাছ থেকে যেসব সরকারি চাকুরেকে দেখেছি, তাদের জীবনটা লোভনীয় নয়— অনেকটাই চোরবাটপারের জীবন। একটা পেশায় অন্তত ৫১% মানুষ দুই নম্বর পয়সা কামায়, সেই পেশা আর যাই হোক, মহৎ পেশা হতে পারে না।
২০০২ সালে সম্ভবত, যুগান্তর থেকে লেখকসম্মানী বাবত ১২০০ টাকার একাউন্টপেয়ী চেক পাই। পোস্তার অগ্রণী ব্যাংকে একাউন্ট করে চেক জমা দিই। টাকা যেদিন ক্যাশ হয়, সেদিন অফিসার আমাকে ১২০০ টাকা দিয়ে এক প্রকার থাবা দিয়ে হাসতে হাসতে ২০০ টাকা নিয়ে নেয়। আমার অবাক হওয়া দেখে বড় আপা আমাকে বলে, এরা এমুনই, বাটপার।
যাই হোক, চব্বিশের জুলাইয়ের যে আন্দোলন, পথঘাটে আমরা খুব সাফার করি। দিনের পর দিন যানজট, খুব বাজে অবস্থা। ভালোই লাগছিলো না। একদিন ছবিতে দেখি, ছাত্রীরা সব লাল-নীল-গোলাপি ফুল-লতা-পাতার প্রিন্টওয়ালা ছাতা নিয়ে শাহবাগ বসে স্লোগান দিচ্ছে। ছবিটা দেখে খুব হাসি পেলো- রোদে যাদের ছাতা লাগে, তাদের আন্দোলনের দৌড় নিয়ে একা-একলাই হাসলাম, দুয়েকজনকে তাচ্ছিল্য করে বললামও।
তারপর একদিন আবু সাঈদ অন ক্যামেরায় Christ the Redeemer হয়ে প্রাণই দিয়ে দিলেন। যমুনা টিভি ভিডিও সম্প্রচার করলো, কাহিনী সবার মুখে মুখে উঠ এলো। পরদিন প্রথম আলো ভিডিও থেকে নিয়ে বড় করে ছবি ছাপলো। নিউজগুলো পড়লাম— পরিস্থিতি অস্বাভাবিক, অচেনা ও ঘোলাটে মনে হলো। আন্দোলনের বিষয়ে আমার ভেতরকার তাচ্ছিল্য নাই হয়ে গেলো। অন ক্যামেরায় প্রাণ দেওয়া সহজ কাজ নয়, পরিস্থিতি গম্ভীর। ভেতরে যেনো বেজে উঠলো— নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান- ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই!
তারপরও অন্য সময়ের মতো স্বাভাবিক জীবনযাপন করছিলাম। অফিসে যাতায়াত একটু জটিল হয়ে আসছে। অবশ্য অতোটা গায়ে মাখিনি। বিএনপির সেই ম্যারাথন অবরোধ চলাকালে জালাওপোড়াওয়ের ভেতর দিয়ে নাগরিক জীবন পেরিয়ে এসেছি, তাই নিজেকে মানিয়ে নিলাম। মারামারি, কাটাকাটি চলছিলো। নতুন আর কী, জীবনভর দেখে আসছি। তারপর একদিন শুনি হেলিকপ্টার থেকে গুলি করা হচ্ছে, শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। খবরাখবর নিয়ে নিশ্চিত হলাম, আসলেই গুলি করা হচ্ছে। রাষ্ট্র তার নিরস্ত্র নাগরিকদের ওপর গুলি করছে, সরাসরি গুলি করছে, এরপর আর নেয়া যায় না। দুনিয়ার সবরকম পপুলার ইতিহাস জানা মানুষ জাকির হোসেনকে কল দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম পৃথিবীর কোনো শাসক কি নিজ দেশের নিরস্ত্র নাগরিকদের ওপর হেলিকপ্টার থেকে গুলি করেছে কখনো? জাকির ভাই বললেন— ‘না’।
বৃষ্টি হলে আমার মেয়েটা ছাদে গিয়ে ভিজে, ভিজে ভিজেই দীর্ঘসময় নিয়ে গোসল করে। দৈনন্দিন জীবনে সবচে আনন্দময় ব্যাপার হিসেবে বৃষ্টিতে ভেজা সে উপভোগ করে। ছাদে যাওয়ার সময় প্রতিবারই বলে যায়। সেদিন বৃষ্টি শুরু হলে মেয়েটা অন্যান্য দিনের মতো বলে, আব্বু ছাদে যাই? বললাম না— হাসিনা হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে। ওরে ‘না’ করতে প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছিলো। সেদিন আর সে ছাদে যায়নি। হাসিনা দেশে থাকতে আর যায় নাই, হাসিনা পালানোর আগ পর্যন্ত আর যায়নি।
৩০ জুলাই প্রোফাইল লাল করে ফেসবুকে লিখি— ‘এই বধ্যভূমি একদিন স্বদেশ ছিলো’।
টানা ৩৬ দিন সর্বত্র তথ্য ও অপতথ্যের ছড়াছড়ি ছিলো, আমি তখন শুধুমাত্র জুলকারনাইন সায়েরকে বিশ্বাস করতাম, উপভোগ করতাম শুধুমাত্র ‘মহাত্মা’ রোদ্দুর রায়কে। তার একেকটা ভিডিও একাধিকবার দেখতাম, শুনতাম। ৩ আগস্ট ফেসবুকে রোদ্দুরের লাইন উদ্ধৃত করলাম— ‘তুমি সেই ক্রীতদাস, যার শিকল খুলে নিলেও সে নড়তে পারে না’। ৪ আগস্ট রোদ্দুর রায় ভিডিওতে বললেন— ‘যেই পৃথিবীতে শিশু মারা যায় পুলিশের গুলিতে, সেই পৃথিবীকে আমি ঘৃণা করি’।
আমি ঘুম থেকে উঠি দেরিতে। ঘুম ভাঙলে পড়ে লম্বাটাইম শুয়ে থেকে তারপর উঠি। ৫ আগস্ট শুয়ে আছি। সাদ রহমান কল দিয়ে বললো, ‘ভাই, সেনাপ্রধান ভাষণ দিবে— এর মানে কী’? সঙ্গে সঙ্গে ফখরুদ্দিনের ভাষণের কথা মনে পড়ে গেলো। ন্যানো সেকেন্ড না ভেবেই বললাম, এর মানে হাসিনার গেম ওভার।
ঠিক দুপুরে খবর পেলাম, বাড়ির গেটে দাড়ানো আমার ছোটভাইকে পিটায়া পুলিশ হাত ভাইঙ্গা দিছে, হাড্ডি গুড়া গুড়া করে ফেলছে। এর কিছুক্ষণ পর— দুপুরের ভাত খাওয়া প্রায় শেষ, চারপাশে জয়োধ্বনি, উল্লাস, চিৎকার, সাটার-গেট পিটাপিটির ধুম-ধাড়াক্কা শব্দ আর প্রচণ্ড কোলাহল। জুলকারনাইন সায়েরের ফেসবুকে গিয়া দেখি ‘হাসিনা পালাইছে’। মেয়েরে নিয়া ছাদে গেলাম, দেখলাম রাস্তায় মানুষ আর মানুষ। ছাদে, জানালায়, বারান্দায় মানুষ আর মানুষ। ফেসবুকে লিখলাম ‘মদীনার ঘরে ঘরে আজ ঈদ’।
রেডি হয়ে অফিসের পথ ধরলাম। স্রোতের মতো মানুষ এলাকায় ঢুকছে, স্রোতের মতো মানুষ এলাকা থেকে বের হচ্ছে। রিকশা নিয়ে অফিসের পথ ধরলাম। সারা পথজুড়েই মানুষ আর মানুষ। বাংলাদেশের মানুষকে আমি কখনো এতো আনন্দিত দেখি নাই। পলাশী থেকে নীলক্ষেত যাওয়ার পথে ব্যানবেইসের সামনে দেখলাম মানুষ সেনাবাহিনীর লোকজনের সঙ্গে ছবি তুলছে, রিক্সা থেকে নেমে আমিও সেলফি তুললম।
আমাদের অফিস সময় টিভি যে বিল্ডিংয়ে, সে বিল্ডিংয়েই। গিয়ে দেখি বিল্ডিংয়ের সামনে সব মানুষ। বিল্ডিংটায় যারা অফিস করেন, সবাই বাইরে, কেউ ঢুকতে পারছে না। অপর পাশে আমাদের কলিগরা অনেকে। বছর দেড়েক হলো সিগারেট ছেড়েছি। তাদের কাছে যাওয়া মাত্রই বাধন অধিকারী আমাকে সিগ্রেট দিয়ে বললেন, আজকে একটা হয়ে যাক। বললাম, আজও নয়। তারপর আমাদেরই এক কলিগ গণভবন থেকে আনা মধু খাওয়ালেন। সেখান থেকে সার্ক ফোয়ারার সামনে গিয়ে মানুষ দেখলাম, আনন্দ দেখলাম, হাসি আর আনন্দাশ্রু দেখলাম মানুষের চোখেমুখে। মানুষের যেনো আজ চূড়ান্ত বিজয়ের দিন, এ বিজয়ের চেয়ে আনন্দের কিছু হয় না।
তারপর, সন্ধ্যার কিছুক্ষণ পর সাংবাদিকদের সঙ্গে ডিএমপির সামনে দিয়ে বঙ্গভবন গেলাম। যেতে যেতে দেখলাম, ডিএমপির কম্পাউন্ডে কোনো মানুষ নেই, কোনো আলো নেই, সব অন্ধকার। বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি, সেনাপ্রধান ও আসিফ নজরুল, ছাত্রনেতা ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বৈঠক হলো। বৈঠক চলাকালে প্রচুর গোলাগুলি হচ্ছিলো পুলিশ হেডকোয়ার্টারের দিকে। ভয় পাওয়ার মতোই গোলাগুলি। আমাদের সামনে আর্মি ও অনেক এপিসি ছিলো, তাই আর ভয় গায়ে মাখিনি।
সেই ৩৬ জুলাইয়ের বছরপূর্তি আজ। অনেকের কাছে অনেক রকম পাওয়া না পাওয়ার হিসাব। আমার হিসাব শূন্য। কারণ আমার কোনো আশাবাদই নেই। প্রায় তিন যুগ রাষ্ট্র ও মানুষকে যতোটা পড়তে পেরেছি, বিশেষ আশাবাদী হওয়ার কারণ এই দেশে খুজে পাইনি। মেয়েটা আমার নির্ভয়ে, নির্বিঘ্নে বৃষ্টিতে ভিজতে পারছে, মেয়েটার বৃষ্টিতে ভিজতে আর বাধা নেই— এতেই আমি সন্তুষ্ট। যতোদিন নিরস্ত্র নাগরিকদের ওপর হেলিকপ্টার থেকে রাষ্ট্রযন্ত্রের গুলিবর্ষণ শুরু না হবে, ততোদিন আমি সন্তুষ্টচিত্তেই থাকবো— সেই আশাবাদ রইলো।