শনিবার, জানুয়ারি ১৮, ২০২৫

ছাত্রদের দমাতে অস্ত্র ও পয়সা যুগিয়েছিলেন ওবায়দুল করিম

by ঢাকাবার্তা
ওরিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান ওবায়দুল করিম

দ্য মিরর এশিয়া ।। 

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময়ে জুলাইয়ের ২৮ এবং ২৯ তারিখে পুলিশ যখন আন্দোলন দমনের নামে নির্বিচারে ছাত্রদের ওপর গুলি করেছিল, তখন ওরিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্য ওবায়দুল করিম সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে খুশি রাখতে পুলিশের উচ্চ মহল এবং ছাত্রলীগ ক্যাডারদের অস্ত্র এবং টাকা পয়সাসহ সার্বিক দিক দিয়ে সাহায্য করে গেছেন বলে জানা গেছে।

অভিযোগ আছে, ভারতের গত নির্বাচনে শেখ হাসিনার মদদে বিজেপিকে ৩০০ মিলিয়ান ডলার নির্বাচনী অর্থ সহায়তা দিয়েছে ওরিয়ন গ্রুপ। এদিকে জ্ঞাত আয়-বহির্ভূত সম্পদ অর্জন, মানিলন্ডারিং ও অর্থ আত্মসাতের পৃথক তিন মামলায় ৪৮ বছরের কারাদন্ডাদেশ মাথায় নিয়ে বহাল তবিয়তে আছেন ওরিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান ওবায়দুল করিম। এতো বছরের কারাদণ্ডাদেশ মাথায় নিয়ে তিনি বিগত স্বৈরাচারী সরকারের প্রধান মন্ত্রীর দপ্তরে কারণে-অকারণে যেতেন, গত সাড়ে ১৫ বছর অসংখ্যবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিদেশেও ঘুরে বেড়িয়েছে।

বিশেষ রাজনৈতিক ক্ষমতার কারণে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী তার গায়ে কোনো স্পর্শ করতে পারেনি। তিনি মামলার নথি গায়েব থেকে শুরু করে নানা কূটকৌশলে শুনানি পিছিয়ে পার করেছেন সাড়ে ১৫ বছর। তবে গতকাল বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ওরিয়ন গ্রুপের কর্ণধার ওবায়দুল করিমের ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে। একই সঙ্গে তার স্ত্রী-সন্তানসহ ৬ জন ও তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ পৃথক প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবও স্থগিত রাখতে বলা হয়েছে।

শহীদ মিনারে লাখো মানুষের ঢল

শহীদ মিনারে লাখো মানুষের ঢল

এ ছাড়াও ওবায়দুল করিম কুকীর্তির সংখ্যা পাহাড় পরিমাণ। হানিফ ফ্লাইওভার নির্মাণে ওরিয়ন গ্রুপ তাদের বিনিয়োগে দেখিয়েছিল ১০০ কোটি টাকা। কিন্তু এর মধ্যে  ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯০ টাকা প্রকল্পের ব্যাংক হিসাবে দেখানো হয়েছে। নানা অনিয়ম দুর্নীতির মাধ্যমে ২ হাজার ১০৮ কোটি টাকার হানিফ ফ্লাইওভার প্রকল্পের মালিক হয়ে গেছে ওরিয়ন গ্রুপ।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, ওরিয়ন গ্রুপের বিভিন্ন সাব কোম্পানির নামে বিশেষ করে ওরিয়ন অয়েল অ্যান্ড শিপিং লিমিটেড, ওরিয়ন ফার্মা, ওরিয়ন পাওয়ার, ওরিয়ন গ্যাস, ভিন্ন ভিন্ন নামে দেশের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে মোট ঋণ নিয়েছেন ১১ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। যার মধ্যে ৯০ শতাংশের মতো তিনি এখনও পরিশোধ করেননি । এ ছাড়া দীর্ঘ ১৪ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জে শীর্ষ ১০ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে ওরিয়ান গ্রুপ চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে।

সাত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নামে ঋণ আত্মসাৎ

১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর  উত্থান হয় ওরিয়ান গ্রুপের মালিক ওবায়দুল করিম। ২০০৯ সালে আবার যখন আওয়ামী লীগ সরকার  ক্ষমতায় আসে, আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপি সহ বড় বড় নেতার যোগসাযোসে ৭টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে স্থাপন করার নামে সেই  প্রতিষ্ঠানের অংশীদার করেন। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর নামে ৭ হাজার কোটি টাকা লোপাট করে ওবায়দুল করিম।

এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নামে ৫ হাজার ২৩৩ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন তিনি। বিদ্যুতের খাতে তার প্রতিষ্ঠানগুলোর থেকে সরকারের কাছ থেকে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে সাড়ে ৪ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা নিয়েছেন। এই বিপুল পরিমাণের অর্থ লোপাটের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছে আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ। তাদের মধ্যে মির্জা আজম, আলাউদ্দিন নাসিম ও শামীম ওসমান উল্লেখযোগ্য। ওরিয়ন গ্রুপের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই এই তিন জনের কারো না কারো শেয়ার ছিল।

বিশ্লেষকেরা বলেছেন, বিদ্যুৎখাত নিয়ে ওরিয়ন গ্রুপ যে নৈরাজ্য করেছে, তা অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে। কেন না, এসব প্রকল্প তারা জনগণকে বিদ্যুৎ দেওয়ার জন্য করেনি। বরং অর্থ লোপাট করার জন্য করেছে। ট্যারিফ বহির্ভূত যে অর্থ তারা নিয়েছে, সেগুলো ফিরিয়ে আনতে হবে।

উল্লেখ্য, ওরিয়ন যখন যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসে, তাদেরই পার্টনার বানিয়ে এ পর্যন্ত ১১৪১৯ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। যেখানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১২৩৯ কোটি টাকা। নারায়ণগঞ্জে ‘ডিজিটাল পাওয়ার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেড’ নামক ১০২ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৬০ শতাংশ শেয়ার ছিল ওরিয়নের। বাকি শেয়ারের মালিক ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা মির্জা আজম ও তার তিন ভাই মির্জা গোলাম কিবরিয়া, মির্জা গোলাম রাব্বানি ও মির্জা জিল্লুর রহমান।

সিদ্ধিরগঞ্জে ‘ডাচ বাংলা পাওয়ার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেড’ নামক ১০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৭০ শতাংশ শেয়ারের মালিক ছিল ওরিয়ন গ্রুপ। বাকি শেয়ারের মালিক ছিল আলাউদ্দিন আহমেদ নাসিম ও তার ভাই জামালউদ্দিন আহমেদ। ‘ওরিয়ন পাওয়ার সোনারগাঁও লিমিটেড’ নামে ১০৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রে শামীম ওসমানকে ৪ শতাংশ দিয়ে বাকি ৯৬ শতাংশ ভোগ করেছে ডিজিটাল পাওয়ার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেড। এই ডিজিটাল পাওয়ার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেডে মালিকানায় ছিল ওরিয়ন গ্রুপ, মির্জা আজম ও তার তিন ভাই।

খুলনায় ‘ওরিয়ন পাওয়ার রূপসা লিমিটেড’ এর ১১০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতায়ও যৌথ মালিকানায় আছে ডিজিটাল পাওয়ার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালিকানায়ও ওরিয়ন গ্রুপের সঙ্গে মির্জা আজম ও তার তিন ভাই ছিলেন। মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় ‘ওরিয়ন পাওয়ার ইউনিট ২, ঢাকা’ ৬৩৫ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতায় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালিকানায় রাখা হয় চীনের ফুজিয়ান লং এনার্জি কোম্পানি লিমিটেড ও দুবাইয়ের ফার্স্টজেন এনার্জি নামের দুই কোম্পানি। কিন্তু অবাক করার বিষয় হলো, এই দুই বিদেশি কোম্পানির মালিক ওরিয়ন গ্রুপের ওবায়দুল করিম ও তার ছেলে সালমান ওবায়দুল করিম। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ১ হাজার ৭৬ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ নিলেও এখন পর্যন্ত কোনো বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হয়নি। ওরিয়ন পরিবারের মালিকানাধীন সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্রেও চীন ও দুবাইয়ের সেই দুই প্রতিষ্ঠানের শেয়ার রয়েছে। মূলত এই দুই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে টাকা পাচার করা হয়। তবে ‘ওরিয়ন পাওয়ার মেঘনাঘাট লিমিটেড’ বিদ্যুৎকেন্দ্রের একক মালিকানায় রয়েছে ওরিয়ন গ্রুপ।

কেন ৪৮ বছরের কারাদণ্ড

জালিয়াতি ও প্রতারণার অভিযোগে ব্যাপক সমালোচিত ওরিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান ওবায়দুল করিম ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে শীর্ষ দুর্নীতিবাজের তালিকার দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন। সে সময় যৌথ বাহিনীর গঠিত দুর্নীতি বিরোধী টাস্কফোর্সের অভিযানের সময় গ্রেপ্তার এড়াতে তিনি আত্মগোপনে ছিলেন। তবে দুর্নীতির মামলা ও সাজা থেকে রক্ষা পাননি। তার অনুপস্থিতিতে বিশেষ আদালতে রায় ঘোষণা হয়। একটিতে যাবজ্জীবনসহ তিনটি মামলায় তার অন্তত ৪৮ বছর কারাদণ্ড হয়।

ব্যবসায়িক জগতে ওবায়দুল করিমের বিতর্কিত আবির্ভাব ঘটে ১৯৯৩ সালে নিলাম হওয়া কোহিনূর কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কেনার মধ্য দিয়ে। ১৯৯৪ সালে শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত হয় ওরিয়ন ইনফিউশন লিমিটেড। ১৯৯৬ সালে যখন দেশের শেয়ার বাজারে বড় ধরনের বিপর্যয় হয়, তখন ওরিয়ন তার শেয়ার হোল্ডারদের জন্য বড় লভ্যাংশ এবং বোনাস শেয়ার ঘোষণা করে। এতে ওরিয়নের শেয়ারের দাম বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। তবে শেয়ার বাজার বিপর্যয়ের পর ওরিয়ন কোনো লভ্যাংশ বা বোনাস শেয়ার দেয়নি। এতে ওরিয়নের বিরুদ্ধে মামলা করে সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন।

অবশ্য ২০০৭ সালে দুদকের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে কিছু বড় বড় প্রকল্পের কাজ পান ওবায়দুল করিম। একই সঙ্গে টেন্ডারে কারচুপি ও অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য পাওয়া গেছে। ওবায়দুল করিমের দুর্নীতি নিয়ে ২০০১ সাল থেকেই দেশে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়। তবে বিভিন্ন প্রভাব বিস্তারের কারণে মামলা হয়নি। ২০০৭ সালে ওয়ান ইলেভেনের পর তার বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা হতে থাকে। কিন্তু তিনি সব সময় সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে অসাধু ব্যক্তিদের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক রেখে এবং অব্যাহত প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে পার পেয়ে গেছেন।

ওরিয়ন গ্রুপ হচ্ছে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম পিন্ডীভূত কোম্পানি। এই প্রতিষ্ঠানটির শিল্পের ক্ষেত্র হচ্ছে- ঔষধ, কসমেটিক ও টয়লেট্রিজ, অবকাঠামো উন্নয়ন, আবাসন, প্রকৌশল, বৈদ্যুতিক শক্তি, কৃষিশিল্পে লগ্নি, অতিথেয়তা, বয়ন, বিমানচালনা এবং ইংরেজি পত্রিকা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড। প্রতিষ্ঠানটির চেয়্যারম্যান ওবায়দুল করিম এটি প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠানটি ঢাকায় মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার তৈরি করেছে। রাজধানীর মতিঝিলে ৩৭ তলা ভবন নির্মাণ করেছে ওরিয়ন গ্রুপ। বর্তমানে এটিই দেশের সর্বোচ্চ ভবন।

You may also like

প্রকাশক : মানজুর এলাহী

সম্পাদক : হামীম কেফায়েত

ব‌ইচিত্র পাবলিশার্স
প্যারিদাস রোড, বাংলাবাজার, ঢাকা ১১০০
যোগাযোগ : +8801712813999
ইমেইল : news@dhakabarta.net