রবিবার, আগস্ট ৩, ২০২৫

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সংকলন ও বাংলা একাডেমির ভূমিকা

by ঢাকাবার্তা
জুলাই গণ-অভ্যুত্থান ও বাংলা একাডেমি। গ্রাফিক, গালা

মোহন রায়হান ।। 

সম্প্রতি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত “জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের কবিতা” ও “জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের গল্প” সংকলন দুটি ঘিরে দেশজুড়ে শুরু হয়েছে নানা আলোচনা-সমালোচনা ও বিতর্কের ঝড়। “বাংলা একাডেমি বাঙালি জাতিসত্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষের প্রতীক”—এই ঘোষণার মর্যাদা রক্ষা করতে হলে সংস্থাটির প্রতিটি কর্মকাণ্ড যেমন হতে হবে গভীর বিবেচনাসম্পন্ন, তেমনি তা হতে হবে নিরপেক্ষ, নৈতিক ও প্রাসঙ্গিক।

আমি নিজে এখনও গ্রন্থদ্বয় হাতে পাইনি। তবে ফেসবুকে প্রকাশিত কবি-লেখকদের তালিকা দেখে অবাক হয়েছি। তালিকায় থাকা বেশিরভাগ লেখকের নামই আমার অপরিচিত। তাদের সাহিত্যকর্মও আমার পড়া হয়নি। প্রজন্মগত ব্যবধান, ফেসবুক-কেন্দ্রিক সাহিত্যচর্চা, কিংবা পাঠাভ্যাসের সীমাবদ্ধতার কারণে এটি স্বাভাবিক। তাই ব্যক্তি-ভিত্তিক লেখার গুণগত মান নিয়ে মন্তব্য করার এখতিয়ার আমার নেই। তবে একজন লেখক, একজন নাগরিক এবং বাংলা একাডেমির জীবন সদস্য হিসেবে সংকলন প্রকাশের নীতিমালা ও নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পর্কে প্রশ্ন তোলার অধিকার আমার আছে—এ বিশ্বাস থেকেই কিছু কথা রাখছি।

প্রথমত, প্রশ্ন উঠে—কোনো আন্দোলন বা গণ-অভ্যুত্থানভিত্তিক সাহিত্য সংকলনে কোন সময়কালের লেখা সংযোজনযোগ্য? কেবলমাত্র আন্দোলনের সরাসরি সময়কালেই রচিত সাহিত্যই কি সংকলিত হবে, না কি আন্দোলনের প্রেক্ষাপট গঠনে পূর্ববর্তী লেখাগুলিও, কিংবা আন্দোলনোত্তর বিশ্লেষণধর্মী, প্রাসঙ্গিক রচনাও স্থান পেতে পারে? উদাহরণস্বরূপ, ভাষা আন্দোলনের কবিতা বলতে আমরা কি শুধু একুশের সময়কালেই লেখা কবিতাগুলোকেই গ্রহণ করি? না কি পরবর্তী দশকগুলিতে এই আন্দোলন নিয়ে রচিত অসংখ্য প্রবন্ধ, কবিতা, গল্পকেও এর অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিই?

একইভাবে, ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৯০-এর স্বৈরাচার পতনের আন্দোলন, কিংবা সাম্প্রতিক ২০২৪-এর জুলাই গণ-অভ্যুত্থান—এই সব ঐতিহাসিক ঘটনাবলি ঘিরে সাহিত্য রচনার সময়সীমা নির্ধারণ কি শুধুই সরাসরি তারিখের গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ?

বিশেষ করে ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থান যেখানে এক মাসব্যাপী বিস্তৃত, সেখানেও প্রশ্ন জাগে—শুধু ৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ফেসবুকে প্রকাশিত লেখাগুলিই কি ‘জুলাই অভ্যুত্থানের’ সাহিত্য হিসেবে বিবেচিত হবে? নাকি ওই দীর্ঘ স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে যারা বছর ধরে লিখেছেন, লড়েছেন, প্রতিবাদ করেছেন, আন্দোলনে সক্রিয় থেকেছেন, তাঁদের সৃজনকর্মই বরং প্রকৃত অর্থে সেই অভ্যুত্থানের প্রেরণাকেন্দ্রিক সাহিত্য?

এখানে আরো এক গভীর সংকট দেখা যাচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে—সংকলনে অন্তর্ভুক্ত অনেক লেখক অতীতে স্বৈরাচারী শাসকের সহযোগী ছিলেন কিংবা সুবিধাভোগী ছিলেন। এমনকি এমন কিছু লেখকের নামও রয়েছে, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সত্তাকে অস্বীকার করে এমন মতাদর্শে বিশ্বাসী। অথচ, যারা বাস্তব জীবনে জীবনবাজি রেখে ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন, পথের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন, ফেসবুক-প্রিন্টমাধ্যমে অকুতোভয় উচ্চারণ করেছেন, সাহিত্যে দ্রোহের ভাষা তৈরি করেছেন—তাঁদের অনেকেই এই সংকলনে উপেক্ষিত হয়েছেন।

এটা শুধু অন্যায় নয়—সাহিত্য, ইতিহাস এবং সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা ও নৈতিকতার সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। কোনো আন্দোলনের সাহিত্য মানে কেবল তখনকার সময়ের সংক্ষিপ্ত চিহ্ন নয়—তা একটি ধারাবাহিক চেতনা ও লড়াইয়ের শিল্পরূপ। আন্দোলনের ভিত রচনায় যাঁরা দীর্ঘকাল ধরে কাজ করেন, তাঁদের উপেক্ষা করা মানেই সেই আন্দোলনের ইতিহাসকেই খণ্ডিতভাবে উপস্থাপন করা।

কবি মোহন রায়হান

কবি মোহন রায়হান

বাংলা একাডেমির মতো রাষ্ট্রীয় সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা সরকারের অনুগত সংস্থা হতে পারে না। এ প্রতিষ্ঠান চলে জনগণের অর্থে—এবং তার কার্যক্রম হতে হবে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ, ন্যায্য ও প্রজ্ঞাসম্পন্ন।

এই পরিপ্রেক্ষিতে “জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সংকলন” বিষয়ে যে গণআলোচনা ও প্রতিবাদ উঠেছে তা স্বাভাবিক। এবং এতে প্রতীয়মান হয়—গ্রন্থ প্রকাশের প্রক্রিয়া ও নির্বাচনী মানদণ্ড নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ, স্বচ্ছ পুনর্বিবেচনার প্রয়োজনীয়তা।

আমরা আশা করি, বাংলা একাডেমি এই ব্যাপারে দায়িত্বশীলতা ও বিবেকবোধের পরিচয় দিয়ে, সত্যিকারের লড়াকু কণ্ঠগুলোকে স্বীকৃতি দেওয়ার পথে অবিলম্বে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেবে। সাহিত্যের ইতিহাস কখনোই ধামাচাপা বা উপেক্ষার মাধ্যমে রচিত হয় না—তা গড়ে ওঠে সত্য, সাহস ও সংগ্রামের মাধ্যমে।

মোহন রায়হান, জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি ও সাওল হার্ট সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান 

You may also like

প্রকাশক : মানজুর এলাহী

সম্পাদক : হামীম কেফায়েত

ব‌ইচিত্র পাবলিশার্স
প্যারিদাস রোড, বাংলাবাজার, ঢাকা ১১০০
যোগাযোগ : +8801712813999
ইমেইল : news@dhakabarta.net