১৬ জুলাই ২০২৪:
শহীদ আবু সাঈদ: ১৬ জুলাই ২০২৪ তারিখ দুপুরে রংপুর শহর থেকে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) প্রধান ফটকের সামনে সমবেত হন। দুপুর ২টার দিকে শিক্ষার্থীরা প্রধান ফটক দিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশের চেষ্টা করেন। তখন পুলিশ তাদের বাধা দেয়। একপর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে পুলিশ অবস্থান নেয়। অন্যদিকে শিক্ষার্থীরা ছিলেন পার্ক মোড়ের দক্ষিণ ও পূর্বদিকে। পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করতে রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ (২২) ছিলেন শিক্ষার্থীদের মিছিলের একেবারে সামনের দিকে। আবু সাঈদ এ সময় বুক চিতিয়ে দুই হাত প্রসারিত করে পুলিশের সামনে দাঁড়িয়ে পড়েন। এ সময় বিপরীত দিকে থাকা পুলিশ সদস্যদের ছুড়তে থাকা বুলেটের আঘাতে একপর্যায়ে বসে পড়েন আবু সাঈদ। হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।(সারা দেশে বিক্ষোভ-সংঘাত, নিহত ৬, প্রথম আলো, ১৭ জুলাই ২০২৪; শিক্ষার্থী নিহতের পর বন্ধ অনির্দিষ্টকালের জন্য, প্রথম আলো, ১৭ জুলাই ২০২৪)
শহীদ ফারুক, ওয়াসিম, ফয়সাল: ১৬ জুলাই ২০২৪ তারিখ চট্টগ্রাম নগরের ষোলশহর স্টেশনে বিক্ষোভ কর্মসূচি করার কথা ছিল কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের। বেলা সাড়ে ৩টায় এই কর্মসূচি শুরুর আগেই স্টেশনে অবস্থান নেয় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। পরে আন্দোলনকারীরা খণ্ড খণ্ড জমায়েতে স্টেশনের দিকে আসতে থাকেন। ৩টার দিকে মুরাদপুর মোড়ে শুরু হয় সংঘর্ষ। চলে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও পাথর নিক্ষেপ। এ সময় অন্তত তিনজন অস্ত্রধারীকে গুলি ছুড়তে দেখা যায়। শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এ সময় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের গুলি ও ককটেলের আঘাতে নিহত হন ফারুক, ওয়াসিম ও ফয়সাল। এর মধ্যে মো. ফারুক (৩২) ছিলেন ফার্নিচার দোকানের কর্মচারী, মো. ওয়াসিম (২২) চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র ও কলেজ শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক ও ফয়সাল আহমেদ (২০) ছিলেন ওমর গণি এমইএস কলেজের স্নাতকের শিক্ষার্থী।
(চট্টগ্রামে তিন ঘণ্টার সংঘর্ষে নিহত ৩, আহত ৫০, প্রথম আলো, ১৭ জুলাই ২০২৪)
শহীদ শাহজাহান, সবুজ: ১৬ জুলাই ২০২৪ দুপুরে ঢাকা কলেজ, সিটি কলেজ ও আইডিয়াল কলেজের কয়েকশ শিক্ষার্থী সায়েন্স ল্যাব মোড়ে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। একপর্যায়ে সায়েন্স ল্যাবের কাছে ঢাকা কলেজের সামনে অবস্থান নেন ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা। ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীদের হাতে দেখা যায় রামদা, রড, লোহার পাইপ, বাঁশ-কাঠের লাঠি। শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণভাবে রাস্তায় অবস্থান করে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল করছিলেন। একপর্যায়ে সরকার সমর্থক নেতাকর্মীরা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। এ সময় নিহত হন মো. শাহজাহান (২৪) ও সবুজ আলী (২৫)। এর মধ্যে শাহজাহান ছিলেন একজন হকার, তিনি বলাকা সিনেমা হলের সামনে হকারি করতেন। আর সবুজ আলী ছিলেন ঢাকা কলেজের পরিসংখ্যান বিভাগের ১৮-১৯ সেশনের শিক্ষার্থী।
(6 killed as violence spreads, দ্য ডেইলি স্টার, ১৭ জুলাই ২০২৪; হামলা-সংঘর্ষে নিভল ৬ প্রাণ, সমকাল, ১৭ জুলাই ২০২৪; ঢাকায় পথে পথে সংঘর্ষ-গুলি, নিহত ২, প্রথম আলো, ১৭ জুলাই ২০২৪; রাজধানীতে নিহত আরেকজনের পরিচয় শনাক্ত, সমকাল, ১৭ জুলাই ২০২৪)
১৮ জুলাই ২০২৪:
শহীদ মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ: খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে স্নাতক শেষ করে ঢাকায় বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসে (বিইউপি) এমবিএ করছিলেন মুগ্ধ(২৬)। লেখাপড়ার পাশাপাশি ভালো খেলোয়াড়, গায়ক, সংগঠক হিসেবে সুপরিচিত। ১৮ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনে রাজধানীর উত্তরায় পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান মুগ্ধ। তাঁর কপালে গুলি লেগে ডান কানের নিচ দিয়ে বেরিয়ে যায়। ক্রিসেন্ট হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। মৃত্যুর মাত্র ১৫ মিনিট আগে ধারণ করা একটি ভিডিওতে দেখা যায়, ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন সড়কে ছোটাছুটি করছেন শিক্ষার্থীরা। এর মধ্যে হাতে পানি ভর্তি বাক্স ও বিস্কুট নিয়ে ছুটছেন মুগ্ধ। ছাত্রদের ডেকে ডেকে বলছেন, ‘পানি লাগবে কারও, পানি’? ভিডিওতে দেখা গেল, অনেকেই তাঁর কাছ থেকে পানি পান করছেন। কাঁদানে গ্যাসের ঝাঁজাল ধোঁয়ায় বেশ কয়েকবার চোখ মুছতে দেখা যায় মুগ্ধকে। তাঁর ফেসবুকজুড়ে ছাত্র আন্দোলনের সমর্থনে লেখা অসংখ্য স্ট্যাটাস। তাতে বৈষম্য-বঞ্চনা থেকে তৈরি হওয়া ক্ষোভের ‘আগুন’। মৃত্যুর আগের দিন সারাদেশে হামলা, রক্তাক্ত ছবি দেখে লিখেছিলেন ‘এই আহাজারি সইতে পারছেন তো’।
(মৃত্যুর ১৫ মিনিট আগেও ছাত্রদের ডেকে ডেকে পানি দিচ্ছিলেন মুগ্ধ, সমকাল, ২৭ জুলাই ২০২৪)
শহীদ ফারহান ফাইয়াজ রাতুল: রাজধানী ঢাকার রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র ফারহান ফাইয়াজ (রাতুল)। তার বয়স ১৮ বছরেরও কম। কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ফারহান ধানমন্ডি এলাকায় অবরোধ করছিল। সেখানে পুলিশের গুলিতে তার মৃত্যু ঘটে। তার বুকে ও মুখে ছিল রাবার বুলেটের ক্ষতচিহ্ন। ফারহান তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে নিজের সম্পর্কে লিখেছিল, ‘একদিন পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে। তবে এমন জীবন গড়ো, যাতে মৃত্যুর পর মানুষ তোমাকে মনে রাখে।’ ফারহানের মৃত্যুর পর তার আত্মীয় নাজিয়া খান হাসিমাখা একটি ছবি পোস্ট করে লেখেন, ‘ দিস ইজ মাই ফারহান ফাইয়াজ। হি ইজ ডেড নাও। আই ওয়ান্ট জাস্টিস।’ (এই আমার ফারহান ফাইয়াজ। সে এখন মৃত। আমি ন্যায়বিচার চাই) কাশফিয়া আহমেদ নামের একজন লেখেন, ‘বাকরুদ্ধ! ভাষাহীন!… এটা কোনো কথা! খুব সহজেই যার সমাধান হয়ে যেত, তার জন্য এত রক্তপাত! তা-ও আবার এমন তরুণ রক্ত! আর নিতে পারছি না সত্যি। দম বন্ধ হয়ে আসছে।
(‘এমন জীবন গড়ো, যাতে মৃত্যুর পর মানুষ মনে রাখে’, প্রথম আলো, ১৯ জুলাই ২০২৪)
শহীদ সাইমন: সাইমন চট্টগ্রাম নগরের বহদ্দারহাটের একটি মুদি দোকানে চাকরি করতেন। ১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার দোকান বন্ধ করে বাড়ি যাওয়ার সময় সাইমন গুলিবিদ্ধ হন। অজ্ঞাতপরিচয় লাশ হিসেবে তিন দিন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের লাশঘরে পড়ে ছিল তার মরদেহ। পরে কয়েকজন আত্মীয় তাকে শনাক্ত করেন। সাইমনের গ্রামের বাড়ি সন্দ্বীপের হারামিয়া ইউনিয়নে। সেখানে জীর্ণশীর্ণ একটি ঘরে তার মায়ের বসবাস। সাইমনের বাবা নেই, তার দুই বছরের বড় এক ভাই আছেন যিনি প্রতিবন্ধী। সাইমন চট্টগ্রামে খালুর মুদি দোকানে কাজ করত। তার মা তাকে দেখতে চট্টগ্রামে গিয়েছিলেন এক সপ্তাহ আগে, সাইমনের সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল মৃত্যুর চার দিন আগে। কথা ছিল বেতন পেয়ে আবার মায়ের কাছে যাবেন। কিন্তু তার আগেই তার গুলিতে মৃত্যু হয়।
(ছেলে সাইমনের লাশ নিয়ে ফিরলেন মা, প্রথম আলো, ২২ জুলাই ২০২৪)
শহীদ আলী হায়দার: পান-সিগারেট বিক্রেতা। ১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর উত্তরার একটি সড়কে গুলিবিদ্ধ হয়ে তার মৃত্যু ঘটে।
(আন্দোলন থেকে চিরনিদ্রায়, সমকাল, ২৩ জুলাই ২০২৪)
শহীদ মেহেদি হাসান: অনলাইন নিউজ পোর্টাল ঢাকা টাইমসের সাংবাদিক মেহেদী হাসান (৩১) ১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। তার ৩ বছর ও ৭ মাস বয়সী দুটি কন্যাসন্তান রয়েছে।
(‘বুকের ধনটারে কে এমনে মারল’, প্রথম আলো, ২৩ জুলাই ২০২৪)
শহীদ আবদুল কাইয়ুম: ১৭ বছর বয়সী আবদুল কাইয়ুম আহাদ কোনো রাজনীতি করত না; পড়ত না কোনো স্কুল কিংবা মাদ্রাসায়। জীবিকার তাগিদে মাধ্যমিকের গণ্ডি পার হওয়ার আগেই গ্রাম ছেড়ে রাজধানী ঢাকায় পাড়ি জমায় সে। যাত্রাবাড়ীতে সে রেফ্রিজারেটর ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) মেরামতের কাজ শিখত। কিন্তু তার কাজ শেখা আর শেষ হলো না। ১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের পাশে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের সময় গুলিতে ঝাঁজরা হয় তার শরীর। আবদুল কাইয়ুমের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার নরোত্তমপুর ইউনিয়নের নরোত্তমপুর গ্রামে। আবদুল কাইয়ুমের মা বিবি খোদেজার আক্ষেপ, ‘আমার ছেলের বুকে গুলি করা হয়েছে। মুখ, গলাসহ বুক গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে গেছে। ডান হাতের কনুই, বাঁ হাঁটু ও বুকের বাঁপাশে গুলি করা হয়েছে। গুলি করে ছেলেকে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলা হয়েছে। কী অপরাধ ছিল আমার ছেলের? কারা আমার বুকের মানিকে রে এভাবে মারল? আমি কী নিয়ে থাকব?’
(ঢাকায় মেকানিকের কাজ শিখতে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরল কিশোর কাইয়ুম, প্রথম আলো অনলাইন, ২৪ জুলাই ২০২৪)
শহীদ লিটন মাতুব্বর: রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় টাইলস মিস্ত্রির কাজ করতেন বরগুনার বেতাগী উপজেলার হোসনাবাদ ইউনিয়নের সোনার বাংলা গ্রামের লিটন মাতুব্বর(৩৫)। ১৮ জুলাই দুপুরে কোটা সংস্কারে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের সময় লিটন রাস্তা পার হয়ে কাজের উদ্দেশ্যে একটি বাসায় যাচ্ছিলেন। সেখানেই গুলিবিদ্ধ হন তিনি। এরপর ঢাকার কুর্মিটোলা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ছয় সদস্যের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন লিটন। লিটনের আয়ে চলত প্রতিবন্ধী বাবার চিকিৎসা। লিটনের মৃত্যুর পরও তার বাবা ছেলেকে মাঝে মধ্যে ডেকে বলেন, ‘লিটন ও লিটন….বাবা তুমি কবে বাড়ি আবা?’
(টিটু-লিটনের পরিবারে অমানিশা, প্রথম আলো, ২৭ জুলাই ২০২৪)
শহীদ জসিম উদ্দীন: ঢাকার উত্তরায় একটি অটোমোবাইলস দোকানে চাকরি করতেন জসিম উদ্দীন (৩৫)। থাকতেন ওই দোকানের গ্যারেজেই। ১৮ জুলাই মালিকের নির্দেশে তিনি ও অপর এক সহকর্মী উত্তরা ৭ নম্বর সেক্টরে যান গাড়ির কিছু যন্ত্রাংশ কিনতে। যন্ত্রাংশ কিনে আসার পথে তিনি বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। তার মুখমণ্ডল ও সারা শরীরে ছিল অসংখ্য রাবার বুলেটের ক্ষত। জসিমের বাড়ি বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার পূর্ব সালিকাবাঁকপুর গ্রামে। দেড় বছর বয়সী ছেলে সাঈফ ও মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস(১০) কে নিয়ে গ্রামের ছোট্ট একটা টিনের ঘরে বসবাস করেন স্ত্রী সুমী আক্তার। বাবার মৃত্যুর খবরে মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস বুক চাপড়াতে চাপড়াতে বলছিল, ‘মা আমার লগে রাগারাগি করলে বাবারে ফোন দিতাম। বাবা বলত, “তোমার আম্মুকে এবার বাড়িতে এসে অনেক বকে দেব।” এখন আমি কার কাছে নালিশ দেব, বাবা…!’
(‘এখন আমি কার কাছে নালিশ দেব, বাবা…’, প্রথম আলো, ২৬ জুলাই ২০২৪)
শহীদ মাহমুদুল হাসান রিজভী: লক্ষ্মীপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ইলেকট্রনিকস বিষয়ে পড়ালেখা শেষ করে জুলাই মাসে ঢাকায় একটি প্রতিষ্ঠানে ইন্টার্নশিপ শুরু করেন মাহমুদুল(২০)। তিন সহপাঠীসহ উত্তরা এলাকার একটি মেসে থাকতেন মাহমুদুল। তার সহপাঠিদের ভাষ্য অনুসারে, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় ১৮ জুলাই আনুমানিক ছয়টার দিকে তাঁরা চার বন্ধু নাশতা করার উদ্দেশ্যে মেস থেকে বের হয়েছিলেন। উত্তরার রাজলক্ষ্মীর দিকে যেতেই মাথায় গুলিবিদ্ধ হয় মাহমুদুল। গুরুতর আহত অবস্থায় স্থানীয় ক্রিসেন্ট হাসপাতালে নিয়ে গেলে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। মাহমুদুলের বাড়ি হাতিয়ায় হলেও তাঁর পরিবার জেলা শহর মাইজদীর বার্লিংটন মোড় এলাকার একটি ভাড়া বাসায় বসবাস করে। মা ফরিদা ইয়াসমিন কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমার ছেলের কী অপরাধ ছিল? আমাকে কেন সন্তানহারা হতে হলো? আমি ছেলে হত্যার বিচার চাই।’
(‘আমার ছেলের কী অপরাধ ছিল, আমাকে কেন সন্তানহারা হতে হলো’, প্রথম আলো, ২৬ জুলাই ২০২৪)
১৯ জুলাই ২০২৪:
শহীদ নাইম হোসেন: নাইম হোসেন (১৭) রওশানাআরা ডিগ্রি কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র। কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেমে ১৯ জুলাই শুক্রবার বিকেলে যাত্রাবাড়ীর সানারপাড় এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারান।
(নাইম আর ফিরবে না ঢাকায়, সমকাল, ২৩ জুলাই ২০২৪)
শহীদ আশিকুল ইসলাম আশিক: ১৯ জুলাই পুলিশের গুলিতে নিহতদের একজন হলো আশিকুল ইসলাম আশিক (১৫)। ঢাকার বনশ্রী এলাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে বিকেল ৫টার দিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে নিহত হয় আশিক। ওই সময় মাথায় গুলি লেগে বাসার সামনে একটি খাবারের দোকানের সামনে লুটিয়ে পড়ে আশিক। আশিক বনশ্রীর একটি মাদ্রাসার অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। পাশাপাশি ফ্যাশন ডিজাইনে কাজ করত। তার স্বপ্ন ছিল সে বড় হয়ে ফ্যাশন ডিজাইনার হবে, ইতালিতে গিয়ে বড় চাকরি করবে।
(‘মা আমি মিছিল দেখে আসি’ বলে বাড়ি থেকে বের হয়েছিল আশিক, প্রথম আলো, ২১ জুলাই ২০২৪)
শহীদ আসিফ, মুত্তাকিন, রাজু: মাগুড়ার এই তিন যুবক ১৯ জুলাই শুক্রবার রাজধানী ঢাকায় পুলিশের গুলিতে নিহত হন। মো. আসিফ ইকবাল (২৯) ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ থেকে স্নাতক শেষ করে একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করতেন। মো. মুত্তাকিন বিল্লাহ (২৫) মিরপুর-১৪-তে একটি বেসরকারি হাসপাতালে চাকরি করতেন। কাজ শেষে ফেরার পথে মিরপুর-১০ এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। মুত্তাকিনের শ্বশুর শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘বিচার করবে কে? কার কাছে বিচার চাইব? বিচার থাকলে কি আর রাস্তায় এভাবে গুলি করে মেরে ফেলত?’ রাজু মোল্লা মোহাম্মদপুরে একটি কুরিয়ার সার্ভিসে চাকরি করতেন। শুক্রবার কর্মস্থলের পাশেই গুলিবদ্ধ হন। নিহত রাজুর সহকর্মী নাঈম হোসেন জানান, পুলিশ ধাওয়া দিলে হাত উঁচু করে ‘অফিসের স্টাফ’ বলে তারা চিৎকার করতে থাকেন। এর মধ্যে রাজু গুলিবিদ্ধ হন।
(‘কার কাছে বিচার চাইব’, প্রথম আলো, ২২ জুলাই ২০২৪)
শহীদ মো. সোহাগ: ভোলার চরফ্যাশনের চরফকিরা গ্রামের সোহাগ (১৬) মা-বাবার সঙ্গে ঢাকার রামপুরা নতুন বাজার এলাকায় বসবাস করত। তার বাবা সালাউদ্দিন স্বপন বিল্ডিং ভাঙার শ্রমিক। বাবার আয়ে সংসার চলে না দেখে বড় ছেলে সোহাগ এক ডিলারের অধীন খাদ্যপণ্য সরবরাহকারী হিসেবে কাজ করত। ১৯ জুলাই শুক্রবার খাদ্যপণ্য পৌঁছে দিতে সাইকেলে করে বেরিয়েছিল সোহাগ। ফোনে কথা বলা অবস্থায় রামপুরা নতুন বাজারে তার মাথার পেছনে গুলি লাগে। ঢাকা মেডিকেলে নেওয়ার পর চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। মোবাইল ফোনে মাকে সে বলেছিল, বাসায় ফিরে ভাত খাবে। কিন্তু সেই ফেরা আর হয়নি।
(পোলায় কইছিল বাসায় আইয়া ভাত খাইব, সমকাল, ২৩ জুলাই ২০২৪)
শহীদ ওমর ফারুক: ঢাকার কবি নজরুল সরকারি কলেজের অনার্স তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ওমর ফারুক ১৯ জুলাই শুক্রবার বিকেলে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী কলেজের সামনের সড়কে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।
(আন্দোলন থেকে চিরনিদ্রায়, সমকাল, ২৩ জুলাই ২০২৪)
শহীদ নাইমা সুলতানা: ঢাকার উত্তরার ৫ নম্বর সড়কে এক ভাড়া বাসার চারতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় নাইমা সুলতানা (১৫)। নাইমা ঢাকার মাইলস্টোন স্কুলের দশম শ্রেণিতে পড়ত।
(‘বুকের ধনটারে কে এমনে মারল’, প্রথম আলো, ২৩ জুলাই ২০২৪)
শহীদ সাফকাত সামির: ১১ বছর বয়সী সাফকাত সামির একটি মাদ্রাসায় পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ত। তার বাসা ঢাকার মিরপুরের কাফরুলে। ১৯ জুলাই শুক্রবার কাফরুল থানার সামনের সড়কে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের দমনে পুলিশের ছোড়া কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়া ঢুকছিল শিশু সামিরের ঘরে। জানালা বন্ধ করতে গেলে বাইরে থেকে গুলি এসে বিদ্ধ করে শিশুটিকে। গুলিটি তার চোখ দিয়ে ঢুকে মাথার পেছন দিয়ে বেরিয়ে গেলে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। ঘরে ছিলেন তার চাচা মশিউর রহমান (১৭)। তার কাঁধেও গুলি লাগে।
(জানালায় দাঁড়াতেই গুলি এসে কেড়ে নিল শিশুটিকে, প্রথম আলো, ২৪ জুলাই ২০২৪)
শহীদ মো. টিটু: কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় ১৯ জুলাই রাজধানী ঢাকার ধানমন্ডিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান পেশায় অ্যাম্বুলেন্স চালক টিটু(৩৬)। তিনি ধানমন্ডিতে একটি বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স কোম্পানিতে চাকরি করতেন। তার গ্রামের বাড়ি বরগুনার বেতাগী উপজেলার হোসনাবাদ ইউনিয়নের দক্ষিণ করুণা গ্রামে। তার পিতা আবদুর রহিম একজন রিকশা চালক। ঘটনার দিন দুপুরের খাবার খেয়ে বাসা থেকে কর্মস্থলে যাওয়ার পথে ধানমন্ডি এলাকায় সংঘর্ষের মধ্যে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান টিটু।
(টিটু-লিটনের পরিবারে অমানিশা, প্রথম আলো, ২৭ জুলাই ২০২৪)
রেদোয়ান হাসান সাগর: ফুলবাড়িয়া ডিগ্রি কলেজে হিসাববিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষা শেষে চতুর্থ বর্ষে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন রেদোয়ান হাসান(২৪) । পড়ালেখার পাশাপাশি ময়মনসিংহ নগরে এমএম কম্পিউটার নামে একটি প্রতিষ্ঠানে খণ্ডকালীন চাকরি করতেন। রেদোয়ান পিতামাতা ও এক বোনের সাথে ময়মনসিংহ নগরের আকুয়া চৌরঙ্গী মোড় এলাকায় থাকতেন। ১৯ জুলাই শুক্রবার ময়মনসিংহ নগরের মিন্টু কলেজ এলাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন রেদোয়ান। সেদিন সন্ধ্যা সাতটার দিকে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সমর্থক ও পুলিশের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন রেদোয়ান হোসেন। রেদোয়ান ১৬ জুলাই থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলনের ঘটনাবলি নিজের ফেসবুকে শেয়ার করতেন। ১৭ জুলাই নিজের ফেসবুকের প্রোফাইল ছবি পরিবর্তন করে রংপুরে নিহত বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র আবু সাঈদের ছবি দেন তিনি। রেদোয়ানের পিতা আসাদুজ্জামান বলেন, ‘আর কোনো মায়ের বুক যেন খালি না হয়। আমার ছেলের রক্তের বদলে দেশে শান্তি ফিরে আসুক।’
(‘আমার ছেলের রক্তের বদলে দেশে শান্তি ফিরে আসুক’, প্রথম আলো, ২৬ জুলাই ২০২৪)
ইমাম হোসেন তাঈম: কলেজ শিক্ষার্থী ইমাম হোসেন তাঈম (১৭) থাকতেন রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায়। তার পিতা ময়নাল হোসেন রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের একজন উপপরিদর্শক। পিতার নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ১৯ জুলাই সকাল ১১ টার দিকে কোটা সংস্কারের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিলে যোগ দিতে বাসা থেকে বেরিয়ে যান। ঘন্টাখানেক পরেই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় ইমাম হোসেন। ঢাকা মেডিকেলের মর্গে তাঈমের মরদেহ খুঁজে পাওয়ার পর ফোনে পিতা ময়নালকে বলতে শোনা যায়, ‘স্যার, আমার ছেলেটা মারা গেছে। বুলেটে ওর বুক ঝাজরা হয়ে গেছে। স্যার, আমার ছেলে আর নেই।’ ঊর্ব্ধতন কর্মকর্তাকে প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, ‘একজনকে মারতে কতগুলো গুলি লাগে স্যার?’
(‘একজনকে মারতে কতগুলো গুলি লাগে, স্যার?’, ডেইলি স্টার অনলাইন বাংলা, ২৪ জুলাই ২০২৪)
শহীদ ইমরান খলিফা: গুলশান-২-এর চারুলতা নামের একটি প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে কাজ করতেন ইমরান খলিফা (৩৩)। তাঁর বাড়ি বরিশালের গৌরনদী উপজেলার নলচিড়া ইউনিয়নের কালনা গ্রামে। স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে ইমরান খলিফা শাহজাদপুর খিলবাড়িটেক নামক স্থানে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতেন। ১৯ জুলাই শুক্রবার তাঁর অফিসে যাওয়ার কথা ছিল সকাল ৮টায়। কিন্তু স্ত্রীর অসুস্থতার কারণে অফিসে দায়িত্ব পালনের সময় পরিবর্তন করে নিয়েছিলেন সন্ধ্যা ৭টায়। অফিস যাওয়ার আগে বাইরের পরিস্থিতি দেখতে ও স্ত্রীর ওষুধ কিনতে গিয়ে সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে শাহজাদপুর বাজারে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান ইমরান। তাঁর বাঁ পাঁজর দিয়ে গুলি ঢুকে ডান পাঁজর দিয়ে নাড়িভুঁড়িসহ বের হয়ে যায়। ইমরানের স্ত্রী শান্তা আক্তার বলেন, ‘আমার স্বামী গরিব মানুষ, সে রাজনীতি বোঝে না, আমি স্বামী হত্যার বিচার চাই।’
(স্ত্রীর ওষুধ কিনতে বাইরে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান ইমরান, প্রথম আলো, ২৬ জুলাই ২০২৪)
শহীদ তাহির জামান প্রিয়: কোটা সংস্কার নিয়ে আন্দোলন চলাকালে ১৯ জুলাই ঢাকার গ্রিন রোডে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান তরুণ আলোকচিত্রী তাহির জামান প্রিয়(২৭)। পাঠশালা-সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইনস্টিটিউট থেকে প্রফেশনাল ফটোগ্রাফি (পেশাদার আলোকচিত্র) কোর্সের ওপর ডিপ্লোমা অধ্যয়ন করেন তিনি। তার মা সামসি আরা জামান লিখেছেন, মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগেও নাকি এক বন্ধুর মাথা ফেটে গেছে বলে ডাক্তার দেখিয়ে তাকে বাসায় রেখে এসেছিল। ২০১৩ সালে রংপুর গণজাগরণ মঞ্চের সে ছিল সংগঠকদের একজন। শুনেছি, ঢাকার গ্রিন রোডে যখন সে তিন বন্ধুসহ দাঁড়িয়ে ছিল, তখন সে গুলিবিদ্ধ হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজে তার লাশ যখন পাওয়া যায়, তখন ওর এক পায়ে লেখা ছিল ৫২ নম্বর সিরিয়াল, আরেক পায়ে লেখা ছিল ‘অজ্ঞাতনামা’। কেন এমন হলো?
(আমার মানিক আর নেই, প্রথম আলো, ২৭ জুলাই ২০২৪)
২০ জুলাই ২০২৪:
শহীদ মোবারক: ১৯ জুলাই শুক্রবার রাজধানীর গ্রিন রোডে মাথায় গুলিবিদ্ধ মোবারক (১৩) মারা যায় ২০ জুলাই শনিবার। কিশোর মোবারক বাবা-মা ও ছোট ভাইয়ের সঙ্গে রাজধানী ঢাকার পান্থপথ বক্স কালভার্ট বস্তিতে থাকত। তাদের চারটি গাভি আছে। দুধ বিক্রি করেই তাদের সংসার চলে। ঘটনার দিন মোবারক গ্রাহকের বাড়ি বাড়ি দুধ পৌঁছে দিতে গিয়েছিল। এ সময় সে গুলিবিদ্ধ হয়।
(কিশোর মোবারকের লাশ এল পরিবারে, প্রথম আলো, ২২ জুলাই ২০২৪)
শহীদ মিনহাজুল ইসলাম: ২০ জুলাই শনিবার গাজীপুরের বড়বাড়ি জয়বাংলা সড়কে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান পোশাক শ্রমিক মিনহাজ (১৭)। নিহত মিনহাজ জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার উত্তর রামশালা গ্রামের বাসিন্দা। মিনহাজের বাবা মালয়েশিয়া প্রবাসী আর মা মানসিক রোগী। তিনি ঢাকার গাজীপুরে বড়বাড়ি এলাকায় খালুর কাছে থাকতেন।
(‘কার কাছে বিচার চাইব’, প্রথম আলো, ২২ জুলাই ২০২৪)
শহীদ রবিউল ইসলাম: ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতি ব্যবসায়ী রবিউল ইসলাম (২৬) ২০ জুলাই শনিবার এক গ্রাহকের বাসায় ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতি পৌঁছে দিতে গিয়ে শনির আখড়ায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। রবিউল তার দোকানের কর্মচারীসহ একটি অটোরিকশায় শনির আখড়া মোড়ের রাস্তা পার হচ্ছিলেন। এ সময় অটোরিকশায় থাকাবস্থায় রবিউলের বুকে একটি গুলি লাগে। এইচএসসি পাসের পর জীবিকার সন্ধানে আট বছর আগে ঢাকায় আসেন বরিশালের যুবক রবিউল। রাজধানীর গেণ্ডারিয়ার এক ইলেকট্রিক দোকানের কর্মচারী হিসেবে কাজ শুরু করে তিল তিল করে জমানো টাকায় তিন বছর আগে নিজেই ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতির ব্যবসা শুরু করেন। তার স্ত্রীর গর্ভে সাত মাসের সন্তান। সন্তানের মুখ দেখার আগেই রবিউলকে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হলো।
(সন্তানের মুখ দেখা হলো না রবিউলের, সমকাল, ২৩ জুলাই ২০২৪)
শহীদ জামাল হোসেন সিকদার: প্রবাসী শ্রমিক হিসেবে সৌদি আরব যাবেন বলে বরিশাল গৌরনদী উপজেলার জামাল (৩৮) ১৯ জুলাই শুক্রবার শনির আখড়ায় এক আত্মীয়ের বাসায় ওঠেন। পরদিন ২০ জুলাই শনিবার কাপড় কিনতে বেরিয়ে ঢাকার চিটাগং রোডে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। সবেমাত্র একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয় জামালের মেয়ে নুজহাত হোসেন জিতু। তার কলেজে ভর্তির মাত্র পাঁচ দিনের মাথায় পিতার মৃত্যু তার জীবনের বাঁক পুরোপুরি বদলে দিল।
(বাবাহীন জীবন কঠিন হয়ে গেল জিতুর, সমকাল, ২৩ জুলাই ২০২৪)
শহীদ আবদুল আহাদ: রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগ এলাকায় বাবা মা’র সাথে ১১ তলা একটি বাড়ির আটতলায় থাকত শিশু আহাদ(৪)। ১৯ জুলাই বিকেল চারটার দিকে বাসার নিচে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগের সংঘর্ষের মধ্যে বাসার বারান্দায় দাঁড়ানো আহাদের ডান চোখে গুলি লাগে। পরের দিন ২০ জুলাই শনিবার রাত সাড়ে আটটার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আহাদের মৃত্যু হয়। আহাদের পিতা আয়কর বিভাগের উচ্চমান সহকারী আবুল হাসান। তাদের গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার মানিকদহ ইউনিয়নের পুখুরিয়া গ্রামে।
(বারান্দায় দাঁড়ানো আহাদের ডান চোখে লাগে গুলি, প্রথম আলো, ২৬ জুলাই ২০২৪)
শহীদ ইফাত হোসেন: রাজধানী ঢাকার যাত্রাবাড়ীর এ কে হাইস্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র ইফাত হোসেন(১৬)। ২০ জুলাই শনিবার রাজধানী ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে সংঘর্ষের সময় বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় ইফাত। সেদিন সকালে বাড়ি থেকে একটু আসি বলে বের হয়েছিল সে। ইফাত হাসানের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার রাজগঞ্জ ইউনিয়নের মনপুরা গ্রামে। ছেলের গুলিবিদ্ধ ছবি দেখিয়ে মা কামরুন নাহার বলেন, ‘আমার ছেলে কোনো অপরাধ করেনি। সে একজন পড়ে থাকা আহত মানুষকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল সেদিন। কোনো রাজনীতি সে করত না। তবু তার বুকে গুলি করা হলো।’
(১৬ বছরের ইফাতের বুকের বাঁ পাশে ছিল গুলির চিহ্ন, প্রথম আলো, ২৫ জুলাই ২০২৪)
শহীদ শেখ শাহরিয়ার বিন মতিন: ঈশ্বরগঞ্জ পৌর এলাকার আইডিয়াল কলেজের মানবিক বিভাগ থেকে চলমান এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন শাহরিয়ার। বাবার চাকরির সুবাদে অনেক সময় ঢাকার কুড়িলে থাকতেন শাহরিয়ার। কোটা সংস্কার আন্দোলনের কারণে পরীক্ষা বন্ধ হওয়ায় ১০ জুলাই ঢাকায় চলে গিয়েছিলেন তিনি। মিরপুর ২ নম্বরে খালার বাসায় বেড়াতে গিয়ে খালাতো ভাই বাদলের সঙ্গে কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নেয়। ১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টার দিকে আন্দোলনকারীদের সাথে পুলিশ ও ছাত্রলীগের সংর্ঘষের মধ্যে মিরপুর ১০ নম্বরের গোলচত্বরের কাছে গুলিবিদ্ধ হয় শাহরিয়ার, খালাতো ভাই বাদলও সেসময় গুলিবিদ্ধ হয়েছিল। শাহরিয়ারের ডান চোখের পাশ দিয়ে গুলি ঢুকে তার মস্তিষ্ক ছেদ হয়ে যায়। পরে ২০ জুলাই শনিবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে থাকা ছেলেকে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। পিতা আবদুল মতিন বলেন, ‘ছোট একটা গুলি আমার ছেলেটারে শেষ করে দিল! ছেলে হত্যার বিচার চাই। কিন্তু কার কাছে বিচার চাইব?’
(‘আন্দোলন আমার বুকের ধন কেড়ে নিল’, প্রথম আলো, ২৭ জুলাই ২০২৪)
২১ জুলাই ২০২৪:
শহীদ মো. আমিন: পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার ভরিপাশা গ্রামের কিশোর আমিন (১৬) ঢাকায় শ্রমিকের কাজ করত। ২১ জুলাই রোববার সন্ধ্যায় ঢাকার দনিয়া এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়।
(‘বুকের ধনটারে কে এমনে মারল’, প্রথম আলো, ২৩ জুলাই ২০২৪)
২৩ জুলাই ২০২৪:
শহীদ শাহরিয়ার শুভ: কোটা সংস্কার নিয়ে আন্দোলন চলাকালে ১৯ জুলাই ঢাকার মিরপুর এলাকায় মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন প্রকৌশলী শাহরিয়ার শুভ। ঢাকায় ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মঙ্গলবার (২৩ জুলাই) সন্ধ্যায় মারা যান তিনি। তার বাড়ি চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার শংকরচন্দ্র গ্রামে। হাসপাতাল থেকে দেওয়া মৃত্যুসনদে বন্দুকের গুলিতে আহত, গুলির আঘাতে মাথার খুলি চুরমার ও মস্তিষ্কে ক্ষতের বর্ণনা দেওয়া হয়। তিনি যশোরের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে তড়িৎ প্রকৌশলে ডিপ্লোমা শেষে ঢাকায় লিফট নির্মাতা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। স্ত্রী রাজিয়া সুলতানা ও সাত মাস বয়সী ছেলেসন্তান মোহাম্মদ মুহিনকে নিয়ে ঢাকার মিরপুর-১ নম্বর এলাকায় ভাড়া বাসায় বসবাস করতেন। ১৮ জুলাই শাহরিয়ার বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে শাহরিয়ার ছোট ভাই ও ছেলের জন্য খাবার কিনতে বাইরে বের হন। বাসা থেকে বের হয়ে কিডনি ফাউন্ডেশনের সামনে আন্দোলনকারী ও পুলিশের সংঘর্ষের মাঝখানে পড়ে যান। এ সময় বসে আত্মরক্ষা করার সময় একটি গুলি এসে শাহরিয়ারের মাথায় আঘাত করে।
(সন্তানের খাবার কিনতে বের হয়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন শাহরিয়ার, চুয়াডাঙ্গায় মাতম, প্রথম আলো অনলাইন, ২৪ জুলাই ২০২৪)
২৪ জুলাই ২০২৪:
শহীদ রিয়া গোপ: সাড়ে ছয় বছর বয়সী রিয়া গোপ মা-বাবার সঙ্গে থাকত নারায়ণগঞ্জ সদরের নয়ামাটি এলাকায়। চারতলা বাড়ির উপরের তলায় থাকত ওরা। ১৯ জুলাই শুক্রবার দুপুরে খাওয়ার পর ছাদে খেলতে গিয়েছিল মেয়েটি। খানিক পরেই রাস্তায় সংঘর্ষ বাধে। বাসার সামনে হইহল্লা শুনে বাবা ছুটে যান ছাদ থেকে মেয়েকে ঘরে আনতে। মেয়েকে কোলে নিতেই একটি বুলেট এসে বিদ্ধ হয় মাথায়। মুহূর্তেই ছোট্ট দেহটি ঢলে পড়ে বাবার কোলে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৪ জুলাই সকালে তার মৃত্যু হয়।
(বাসার ছাদে বাবার কোলে ঢলে পড়ে ছোট্ট মেয়েটি, প্রথম আলো, ২৫ জুলাই ২০২৪)