ডেস্ক রিপোর্ট ।।
পাকিস্তানে মৌসুমি বৃষ্টিপাত শুরুর আগে গত তিন সপ্তাহে জলবায়ুজনিত বিভিন্ন ঘটনায় অন্তত ১২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। নিহতদের মধ্যে ৬৩ জন শিশু। এই তথ্য জানিয়েছে দেশটির জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ (এনডিএমএ)।
বুধবার প্রকাশিত সর্বশেষ পরিস্থিতি প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ২৬ জুন থেকে ঘরবাড়ি ধসে ও আকস্মিক বন্যায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া পানিতে ডুবে মৃত্যু হয়েছে শতকরা প্রায় ১০ শতাংশেরও বেশি।
সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পাঞ্জাব ও খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশ। পাঞ্জাবে মারা গেছে ৪৯ জন এবং খাইবার পাখতুনখোয়ায় ৩৮ জন। লাহোরে ভারী বৃষ্টিতে বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে বহু এলাকা, জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় শহরের নিচু এলাকায়। খাইবার পাখতুনখোয়াতেও ভারী বৃষ্টিপাতে এবং নদীতে গোসল করতে গিয়ে একই পরিবারের ৯ সদস্য মারা যায়।
পাকিস্তান আবহাওয়া অধিদপ্তর সতর্ক করে বলেছে, সামনে আরও একটি শক্তিশালী মৌসুমি বৃষ্টিপাতের প্রবণতা রয়েছে, যা খাইবার পাখতুনখোয়া ও পাঞ্জাবের বিস্তৃত অংশে প্রভাব ফেলবে। যদিও ২০২২ সালের ভয়াবহ নদীভিত্তিক বন্যার পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনা এই মুহূর্তে কম বলে মনে করছে এনডিএমএ।
গিলগিট-বালতিস্তান অঞ্চলের তীব্র তাপপ্রবাহ জলবায়ু সংকটকে আরও জটিল করে তুলেছে। ওই অঞ্চলে ১২০০ মিটার উচ্চতায়ও তাপমাত্রা ৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়েছে। এতে দ্রুত হিমবাহ গলতে শুরু করেছে, যা আকস্মিক বন্যা ও অবকাঠামোগত ক্ষতির ঝুঁকি বাড়িয়েছে।
পরিবেশবিদ সিতারা পারভিন জানান, জুন মাসের তাপপ্রবাহ হিমবাহ গলনের গতি বাড়িয়েছে এবং ‘লিটল আইস এইজ’-এর মত আবহাওয়ার প্যাটার্নের প্রমাণ মিলছে। গিলগিট-বালতিস্তানের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের মহাপরিচালক জাকির হোসেন জানিয়েছেন, হিমবাহ থেকে সৃষ্ট হ্রদের আকস্মিক বিস্ফোরণ (GLOF)-এর সম্ভাবনাও রয়েছে।
বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম হিমবাহ অঞ্চল গিলগিট-বালতিস্তান, যেখানে ১৩ হাজারের বেশি হিমবাহ রয়েছে। এই অঞ্চলে দ্রুত হিমবাহ গলে ভয়াবহ বন্যা ও ভূমি ক্ষয়ের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

কাসুর জেলার চাঁদা সিংহ ওয়ালা গ্রামে বন্যাকবলিত এলাকায় নিজেদের জিনিসপত্র নিয়ে পার হচ্ছেন মানুষজন।
পাকিস্তানের সরকার জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক সহায়তার অভাবের অভিযোগ তুললেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের দীর্ঘদিনের অদক্ষতা এবং নীতিগত ব্যর্থতাও এই সংকটকে বাড়িয়ে তুলেছে। নদীতীরবর্তী এলাকা ও পাহাড়ি ঢালে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে বাড়িঘর নির্মাণ এবং নগর পরিকল্পনার অভাব মৃত্যুর সংখ্যা বাড়িয়েছে।
জাতিসংঘ হ্যাবিট্যাটের ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে দেখা যায়, পাকিস্তানের শহরাঞ্চলের ৫০ শতাংশ মানুষ বস্তি বা অনানুষ্ঠানিক বসতিতে বাস করেন। এনডিএমএ এখন ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করে আগে থেকেই সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা নিচ্ছে এবং স্থানীয় প্রশাসনকে সতর্কবার্তা দিচ্ছে।
জলবায়ু বিশ্লেষক আলি তৌকির শেখ বলেন, “এই মৃত্যু ও ক্ষতির কারণ হলো পদক্ষেপ না নেওয়ার মূল্য।” তিনি সরকারের নীতিগত সংস্কারের অভাবের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, ২০২২ সালের বন্যার পরও কার্যকর কোনো পরিবর্তন হয়নি।
পাকিস্তান মাত্র ০.৫ শতাংশ বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণের জন্য দায়ী হলেও জলবায়ু দুর্যোগে তাদের মৃত্যুঝুঁকি অন্য দেশের তুলনায় ১৫ গুণ বেশি। ২০২৩ সালে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বিশ্ব সম্প্রদায়কে পাকিস্তানের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন।
তবে প্রতিশ্রুত প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ২০২৪ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান পেয়েছে মাত্র ২.৮ বিলিয়ন ডলার। অথচ দেশটির জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় প্রতিবছর ২০৫০ সাল পর্যন্ত ৪০-৫০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।