শনিবার, ডিসেম্বর ৬, ২০২৫

লায়লা খালেদ: ফিলিস্তিনি মুক্তিসংগ্রামের প্রতীক

by ঢাকাবার্তা
লায়লা খালেদ। ফাইল ফটো

ইভন রিডলি ।। 

মাঝেমধ্যে কিছু মানুষ ইতিহাসের গায়ে এমন এক ছাপ ফেলে যান, যেটা সময় মুছে ফেলতে পারে না। এই লেখাটা আমি শুরু করছি এক গভীর আবেগ আর শ্রদ্ধার সঙ্গে—লায়লা খালেদকে নিয়ে। সেই নারী, যাঁকে দেখলে কিশোর বয়সে বুক ধড়ফড় করত, চোখ জ্বলজ্বল করত, আর মনে হতো—এই তো বিপ্লব!

৭০-এর দশকে আমরা যারা তখন কৈশোর পেরিয়ে তরুণ হবার পথে, আমাদের কাছে লায়লা খালেদ ছিলেন একজন জীবন্ত পোস্টার। সাহসিকতা, নাটকীয়তা, আর দৃঢ় সংকল্পের জীবন্ত রূপ। তাঁর হ্যাংলা-পাতলা গড়নের মধ্যেও ছিল অব্যক্ত এক আগুন, যেন অড্রে হেপবর্নের কোমল মুখে বন্দুকধারী বিপ্লবীর ছায়া। কে ভেবেছিল এমন এক চেহারার মেয়েও হতে পারে ভয়হীন?

ইংল্যান্ডের এক নিরামিষ, শ্রমজীবী পাড়ায় বেড়ে ওঠা মেয়েটি হঠাৎ করেই বিশ্বমঞ্চে উঠে এলেন এক বিস্ময়কর দৃশ্যে—এক হাতে একে-৪৭, মুখে কাফায়া, চোখে বিদ্রোহের আগুন। কিশোরীরা যেমন তাঁর পোস্টার দিত ঘরের দেয়ালে, ঠিক তেমনি ছেলেরা করত চে গুয়েভারার ছবি ঝুলিয়ে।

সে সময়কার হ্যাভারস্যাকের গল্প মনে আছে? সবার ব্যাগে আঁকা থাকত বিপ্লবীদের মুখ। ছেলেদের ব্যাগে চে, আর মেয়েদের ব্যাগে? ধীরে ধীরে জায়গা করে নিলেন লায়লা। কারণ, তিনি ছিলেন একমাত্র নারী, যিনি উড়োজাহাজ ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা ঘটিয়ে পুরো বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন—দু’বার। দ্বিতীয়বার চেহারা বদল করে! আর বয়স? তখনো ত্রিশ হয়নি।

লায়লার গল্প শুধু বীরত্বের নয়, বরং প্রতিরোধের প্রতিচ্ছবি। তাঁর অস্ত্র হাতে নেওয়া, তাঁর ছদ্মবেশ, তাঁর বন্দিদশা ও মুক্তির নাটক—সব মিলিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সেই সময়কার নারী শক্তির প্রতীক।

লায়লা আমাদের মতো এক প্রজন্মকে রাজনীতির বাইরে থেকে রাজনীতিতে টেনে এনেছিলেন। যাঁরা কোনোদিন কিছুতেই আগ্রহ দেখাত না, তাঁরাই ফিলিস্তিনিদের ন্যায্যতার পক্ষে স্বাক্ষর দিতে শুরু করেছিল।

তাঁর জীবন ছিল সংকটের, কিন্তু সেসব সংকটকে তিনি রূপান্তর করেছিলেন প্রতিরোধে। লেখক পলা স্মিটের ভাষায়, “লায়লার জন্য একজন উদ্বাস্তুর জীবন মানে ছিল অবজ্ঞা আর অপমানের মধ্যে বেঁচে থাকা। তিনি বেছে নিয়েছিলেন দ্বিতীয় বিকল্পটি—হাতে কালাশনিকভ।” সেটাই তাঁকে আলাদা করে।

আজ যখন পশ্চিম তীর আর গাজা উপত্যকায় দেখি তরুণদের বিদ্রোহ, তখন মনে হয়, সেই পুরনো চেহারাগুলো আর নেই। সেক্যুলার বামপন্থার জায়গা দখল করে নিয়েছে ধর্মভিত্তিক সংগঠন। লায়লা খালেদের মতো নারীরা ইতিহাসের পাতা থেকে যেন মুছে যেতে বসেছে।

কিন্তু ইতিহাসকে তো পুরোপুরি মুছে ফেলা যায় না। জেরুজালেমের দেয়ালে আঁকা তাঁর ছবিটা যেন প্রমাণ করে—লায়লা এখনো রয়ে গেছেন। শুধু মুখে না, চেতনায়। প্রতিরোধের মুখ হয়ে।

আজ তিনি আশি পেরিয়েছেন। জর্ডানে শয্যাশায়ী। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারণে তাঁর শরীর থেমে গেছে, কিন্তু আমাদের হৃদয়ে তিনি এখনো এক অদম্য কণ্ঠস্বর।

ভাবি, যদি আজকের প্রেক্ষাপটে লায়লা আবার জন্মাতেন, তাহলে কি আবারও হাতে তুলে নিতেন তাঁর বন্দুকটা? ইতিহাস হয়তো সেটা বলে না। কিন্তু আমরা যারা তাঁর গল্প শুনে বড় হয়েছি, আমরা জানি—হ্যাঁ, তিনি করতেন।

লায়লা খালেদ শুধু এক নারী নন, তিনি এক বিস্ময়। এক প্রতীক। এক প্রতিবাদের মুখ। ইতিহাস তাঁকে মুছে ফেলতে পারবে না।

লেখক, ব্রিটিশ সাংবাদিক ও লেখক

You may also like

প্রকাশক : মানজুর এলাহী

সম্পাদক : হামীম কেফায়েত

ব‌ইচিত্র পাবলিশার্স
প্যারিদাস রোড, বাংলাবাজার, ঢাকা ১১০০
যোগাযোগ : +8801712813999
ইমেইল : news@dhakabarta.net