ডেস্ক রিপোর্ট ।।
রাশিয়া মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘদিন ধরে সূক্ষ্ম ভারসাম্যের কূটনীতি বজায় রেখে আসছে। দেশটি একদিকে যেমন ইসরায়েলের সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্ক উপভোগ করে, অন্যদিকে তেমনি ইরানের সঙ্গে গড়ে তুলেছে শক্তিশালী সামরিক ও অর্থনৈতিক জোট। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র যখন আকস্মিকভাবে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা হামলা চালায়, তখন এই অঞ্চলিক সংকটে রাশিয়ার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে থাকে। প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এসব প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে জানান, রাশিয়ার প্রায় ২০ লাখ রুশভাষী মানুষ ইসরায়েলে বাস করে এবং দেশটির জনসংখ্যার প্রায় ১৫ শতাংশ মুসলমান হওয়ায় মধ্যপ্রাচ্যে তাদের কৌশলগত ভারসাম্য বজায় রাখা জরুরি। মস্কো ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) পর্যবেক্ষক সদস্যও বটে।
ইরানের পুরোনো মিত্র রাশিয়া। দেশটি ইরানের বুশেহর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে সহায়তা করেছে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইরানের সঙ্গে আস্থাভিত্তিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। কিন্তু ইসরায়েলের সাম্প্রতিক আক্রমণ, যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি হামলা এবং ইরানের প্রতিক্রিয়ার মাঝে রাশিয়ার ভূমিকা ছিল নীরব দর্শকের মতো। দেশটি কেবল মার্কিন হামলাকে ‘আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন’ বলে নিন্দা জানিয়েছে এবং রাজনৈতিক সমাধানের আহ্বান জানিয়েছে। অথচ ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ইরানের সঙ্গে স্বাক্ষরিত কৌশলগত অংশীদারত্ব চুক্তি রাশিয়াকে সামরিক জোটে বাধ্য করে না।
ইরান যখন একের পর এক হামলার মুখে পড়ে দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন রাশিয়া আড়ালেই থেকে যায়। সিরিয়ার বাশার আল-আসাদ ক্ষমতা হারানোর পরও রাশিয়া প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ করেনি, বরং ইরানকে উন্নত যুদ্ধবিমান বা শক্তিশালী আকাশ প্রতিরক্ষা সরবরাহ করতেও গড়িমসি করেছে। ফলে ইরানের রাশিয়ানির্মিত এস-৩০০ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও ইসরায়েলি হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই অবস্থায় রাশিয়া এমন এক পথ বেছে নিয়েছে, যেখানে সে ইরানকে সামরিকভাবে সহায়তা না করে পশ্চিমবিরোধী বক্তব্যে ঐক্যবদ্ধ থাকার চেষ্টা করছে।
ইরান একসময় রাশিয়াকে শাহেদ ড্রোন দিয়েছিল, যা ইউক্রেন যুদ্ধে মস্কোর জন্য ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এখন রাশিয়া নিজেই সেসব ড্রোন উৎপাদন করতে সক্ষম। ফলে ইরানের ওপর রাশিয়ার নির্ভরতা অনেকটাই কমে এসেছে। তাছাড়া হরমুজ প্রণালির উত্তেজনা তেলের দাম বাড়ালে রাশিয়ার অর্থনীতি উপকৃত হবে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে সরে মধ্যপ্রাচ্যে গেলে রাশিয়ার জন্য কিছুটা অবকাশও তৈরি হবে। এসব বিবেচনায় রাশিয়া চায় না ইরান পুরোপুরি পরমাণু শক্তিধর হোক বা যুক্তরাষ্ট্র তার ওপর সরাসরি আগ্রাসন চালাক।
রাশিয়া এখন ইরানকে সামরিক সহায়তা দিলে সেসব অস্ত্র ইসরায়েল সহজেই ধ্বংস করে দেবে বলে মনে করে। পুতিন এমন পরিস্থিতে হেরে যাওয়া দলের পক্ষে দাঁড়াতে চান না। ফলে রাশিয়া ইরানের জন্য ন্যূনতম কূটনৈতিক অবস্থান বজায় রাখলেও বাস্তবে কোনও প্রতিরোধমূলক সহায়তা করছে না। এ ছাড়া ইসরায়েলের সঙ্গে তার পুরোনো জটিল সম্পর্ক, ওপেকের সঙ্গে তেল দামের সমন্বয় এবং মধ্যপ্রাচ্যে তার নিজস্ব স্বার্থ বিবেচনায় ইরানকে প্রকাশ্যে সাহায্য করার ঝুঁকি নিতে চাইছে না মস্কো।
এদিকে রাশিয়া যদি ইরানকে নিরস্ত্র দেখে, তাহলে হয়তো পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি থেকেও সরে আসতে পারে তেহরান। এই পরিস্থিতি রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার সীমা প্রকাশ করে দেবে। তবুও, যুদ্ধ পরিস্থিতিতে রাশিয়া নিজেকে কূটনৈতিক শক্তি হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করছে। পুতিন ট্রাম্পকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রকে ইরানের সঙ্গে সমঝোতায় সহায়তার প্রস্তাবও দিয়েছেন। মূলত এটি ইউক্রেন যুদ্ধের যুদ্ধবিরতির সময় বাড়াতে রাশিয়ার একটি কৌশল।
তবে বাস্তবতা হলো, রাশিয়া এখন ইউক্রেন যুদ্ধে সম্পূর্ণভাবে ব্যস্ত। এ অবস্থায় তাদের পক্ষে ইরানকে বাঁচাতে সামরিক ঝুঁকি নেওয়া সম্ভব নয়। মধ্যপ্রাচ্যে আরেকজন কৌশলগত মিত্র হারানোর আশঙ্কা রাশিয়ার জন্য বড় একটি উদ্বেগ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে যখন সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের পতনের পর ইরানের সরকার পরিবর্তনের সম্ভাবনাও দেখা দিচ্ছে। তাতে দক্ষিণ ককেশাস অঞ্চলেও অস্থিতিশীলতা ছড়িয়ে পড়তে পারে, যা রাশিয়ার জন্য আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠবে।
রাশিয়ার গণমাধ্যমগুলো যদিও মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনাকে একটি সম্ভাবনা হিসেবে উপস্থাপন করেছে—বিশ্বের মনোযোগ ইউক্রেন থেকে সরে আসবে, তেলের দাম বাড়বে, রাশিয়া মধ্যস্থতার মাধ্যমে আবার বড় শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারবে—তবে বাস্তবে এই সংঘাতে রাশিয়ার সম্ভাব্য ক্ষতির আশঙ্কাও প্রবল। রাশিয়ার রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আন্দ্রেই কর্তুনভও বলেছেন, মস্কো শুধু রাজনৈতিক বিবৃতিতে সীমাবদ্ধ থাকতে চায় এবং ইরানকে সামরিক সহায়তা দিতে প্রস্তুত নয়।
অর্থনৈতিক ফোরাম, বৈঠক ও আন্তর্জাতিক মঞ্চে রাশিয়া কূটনৈতিক শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—এই নীরব দর্শকের ভূমিকায় থেকে পুতিন ঠিক কোন খেলা খেলছেন? এই প্রশ্নের উত্তর সময়ই দেবে, তবে আপাতত রাশিয়া চাইছে না কোনও বড় সামরিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে—ইরানের জন্য হলেও না।