ডেস্ক রিপোর্ট ।।
অধিকৃত ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইসরায়েলের দখলদারিতে সহায়তাকারী ৪৮টি প্রতিষ্ঠানের তালিকা প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘের বিশেষ দূত ফ্রানচেসকা আলবানিজ। এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে ইসরায়েলের গণহত্যা ও ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুতিতে সহায়তার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে। আলবানিজের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এসব কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
প্রতিবেদন প্রকাশ ও জেনেভায় উপস্থাপন
প্রতিবেদনটি ২০২৪ সালের ১৩ জুন বৃহস্পতিবার জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে উপস্থাপন করার কথা রয়েছে। এতে বিশ্বের ১,০০০-এরও বেশি করপোরেট প্রতিষ্ঠানের ওপর গবেষণা করে ৪৮টি প্রতিষ্ঠানকে সরাসরি অভিযুক্ত করা হয়েছে। তালিকায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রযুক্তি জায়ান্ট মাইক্রোসফট, গুগলের মূল প্রতিষ্ঠান অ্যালফাবেট ইনকরপোরেটেড এবং আমাজন।

জাতিসংঘের বিশেষ দূত ফ্রানচেসকা আলবানিজ
‘দখলদারির অর্থনীতি’ থেকে ‘গণহত্যার অর্থনীতি’
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েলের ‘চিরস্থায়ী দখল’ অস্ত্র নির্মাতা ও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য এক পরীক্ষাগার হয়ে উঠেছে, যেখানে সরবরাহ ও চাহিদা উভয়ের সুযোগ রয়েছে, নজরদারির অভাব রয়েছে এবং জবাবদিহিতার কোনো বালাই নেই। আলবানিজ বলেন, এই প্রতিষ্ঠানগুলো এখন শুধু দখলদারিতে জড়িত নয়, বরং ‘গণহত্যার অর্থনীতির’ অংশে পরিণত হয়েছে।
অস্ত্র ও প্রযুক্তি খাতের জড়িত প্রতিষ্ঠান
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান প্রকল্পে অন্তত ১,৬০০ কোম্পানি অংশগ্রহণ করছে। এর নেতৃত্বে রয়েছে লকহিড মার্টিন। ইতালির লিওনার্দো এসপিএ এবং জাপানের FANUC করপোরেশন এই প্রকল্পে যন্ত্রাংশ ও প্রযুক্তি সরবরাহ করে।
আইবিএম, পালানটিয়ার, অ্যামাজন, মাইক্রোসফট ও অ্যালফাবেট ইসরায়েলের বায়োমেট্রিক নজরদারির জন্য ক্লাউড ও এআই প্রযুক্তি সরবরাহ করছে। পালানটিয়ার ‘ল্যাভেন্ডার’, ‘গসপেল’ ও ‘হোয়্যার ইজ ড্যাডি’ নামের এআই সিস্টেম ব্যবহার করে টার্গেট তালিকা তৈরি করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
দখলদারিত্বে ব্যবহৃত দ্বৈত-ব্যবহারযোগ্য প্রযুক্তি
ক্যাটারপিলার, ভলভো, হুন্দাই, লিওনার্দোর মালিকানাধীন রাডা ইলেকট্রনিক ইন্ডাস্ট্রিজ ইসরায়েলের অবৈধ বসতি নির্মাণে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে। বুকিং ডট কম ও এয়ারবিএনবি অবৈধ বসতিতে হোটেল ও ঘরবাড়ি ভাড়া দিয়ে দখলদারত্বকে স্বীকৃতি দিচ্ছে।
বড় বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা
ব্ল্যাকরক ও ভ্যানগার্ড—যুক্তরাষ্ট্রের দুটি বৃহত্তম সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান—এই কোম্পানিগুলোর বড় অংশীদার। ব্ল্যাকরক যেমন মাইক্রোসফট, অ্যামাজন, পালানটিয়ার ও ক্যাটারপিলারে বড় বিনিয়োগ করেছে, তেমনি ভ্যানগার্ডও ক্যাটারপিলার, পালানটিয়ার ও লকহিড মার্টিনে বিনিয়োগ করেছে।
লাভজনক যুদ্ধ ও অর্থনৈতিক লাভ
২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসন শুরুর পর এই প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ারের দাম বেড়ে গেছে। ইসরায়েলের সামরিক ব্যয় ২০২৩-২৪ সালে ৬৫ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৬.৫ বিলিয়ন ডলার। তেল আবিব স্টক এক্সচেঞ্জের মূল্য ১৭৯ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫৭.৯ বিলিয়ন ডলারে।
আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় দায়বদ্ধতা
আলবানিজের মতে, এসব করপোরেট প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী দায়ী হতে পারে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঝুঁকি থাকলে সাপ্লাই চেইনসহ যেকোনো সম্পর্ক বা কার্যক্রম পর্যালোচনা করতে হবে। ব্যর্থ হলে তা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে এবং প্রতিষ্ঠান প্রধানদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে তলব করা যেতে পারে।
আন্তর্জাতিক আদালতের মতামত ও জাতিসংঘের নির্দেশনা
২০২৪ সালের জুলাইয়ে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (ICJ) এক পরামর্শমূলক মতামতে জানায়, পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে ইসরায়েলের দখল অবিলম্বে শেষ করা উচিত। এই মতামতের ভিত্তিতে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে মধ্যে দখলদারত্ব বন্ধে নির্দেশ দিয়েছে।
উপসংহার
আলবানিজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “ঔপনিবেশিক কর্মকাণ্ড এবং সংশ্লিষ্ট গণহত্যা করপোরেট খাত দ্বারা পরিচালিত ও অর্থায়িত হয়ে আসছে।” এখন সময় এসেছে এসব করপোরেট প্রতিষ্ঠানের দায় নিরূপণ ও তাদের দখলদার কার্যক্রম থেকে সরে আসতে বাধ্য করার।
নিচে ফ্রানচেসকা আলবানিজের প্রতিবেদনে উল্লিখিত প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকা দেওয়া হলো
১. মাইক্রোসফট, যুক্তরাষ্ট্র
২. অ্যালফাবেট (গুগলের মূল প্রতিষ্ঠান), যুক্তরাষ্ট্র
৩. অ্যামাজন, যুক্তরাষ্ট্র
৪. আইবিএম, যুক্তরাষ্ট্র
৫. পালানটিয়ার টেকনোলজিস, যুক্তরাষ্ট্র
৬. লকহিড মার্টিন, যুক্তরাষ্ট্র
৭. লিওনার্দো এসপিএ, ইতালি
৮. ফানুক করপোরেশন, জাপান
৯. রাডা ইলেকট্রনিক ইন্ডাস্ট্রিজ, ইসরায়েল
১০. এলবিট সিস্টেমস, ইসরায়েল
১১. ক্যাটারপিলার, যুক্তরাষ্ট্র
১২. এইচডি হুন্দাই, দক্ষিণ কোরিয়া
১৩. ভলভো গ্রুপ, সুইডেন
১৪. বুকিং ডট কম, নেদারল্যান্ডস
১৫. এয়ারবিএনবি, যুক্তরাষ্ট্র
১৬. ড্রামন্ড কোম্পানি, যুক্তরাষ্ট্র
১৭. গ্লেনকোর, সুইজারল্যান্ড
১৮. ব্রাইট ডেইরি অ্যান্ড ফুড, চীন
১৯. তনুভা (মালিক: ব্রাইট ডেইরি), ইসরায়েল
২০. নেটাফিম (মালিক: অর্বিয়া অ্যাডভান্স করপোরেশন), মেক্সিকো
২১. ব্ল্যাকরক, যুক্তরাষ্ট্র
২২. ভ্যানগার্ড, যুক্তরাষ্ট্র
২৩. বিপিএন প্যারিবা, ফ্রান্স
২৪. বার্কলেস, যুক্তরাজ্য
২৫. অ্যালিয়্যাঞ্জ, জার্মানি
২৬. অ্যাক্সা, ফ্রান্স
প্রতিবেদনে মোট ৪৮টি প্রতিষ্ঠানের কথা বলা হলেও এখন পর্যন্ত এই ২৬টি প্রতিষ্ঠানের নাম সরাসরি প্রকাশ পেয়েছে। আরও ২২টি কোম্পানি আছে যেগুলো বেসামরিক প্রযুক্তির দ্বৈত ব্যবহার (dual-use) হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, বা যারা সরাসরি বিনিয়োগের মাধ্যমে ইসরায়েলের দখলদার নীতিতে লাভবান হচ্ছে। জাতিসংঘ তাদের নাম সংরক্ষিত রেখেছে কিংবা পর্যবেক্ষণের মধ্যে রেখেছে।