সোমবার, ডিসেম্বর ৮, ২০২৫

‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও পট-পরিবর্তনের জন্য গণবিপ্লবের বিকল্প নেই’

সিলেট শহর থেকে অনেক দূরে গহরপুর জামিয়া, পুরো নাম জামিয়া হুসাইনিয়া ইসলামিয়া। প্রতিষ্ঠাতা শাইখুল হাদীস হাফিজ মাওলানা নুরুদ্দীন গহরপুরী রহ.। শহর থেকে এবং দেশের কেন্দ্র থেকে অনেক দূরে হলেও মাদরাসাটি আমাদের জ্ঞানচর্চায় বিশেষ ভূমিকা রেখে চলেছে। এর নেপথ্যে যারা ছিলেন অথবা আছেন, তাদের চিন্তাভাবনাও বেশ শাণিত। ইলমী মূলধারার সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পৃক্ততা বজায় রেখেও বিশেষ কিছু উদ্যোগ যেমন রয়েছে তাদের, তেমনি রয়েছে অনেক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনাও। এসব তৎপরতার মূলে আছেন শায়খের সাহেবজাদা ও জামিয়ার বর্তমান প্রিন্সিপাল হাফিজ মাওলানা মুসলেহুদ্দীন রাজু। তিনি বেফাকের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকও। শীতের এক রাতে আমরা ঢাকা থেকে সিলেটে হাজির হই। ভোরবেলায়  (২৭ নভেম্বর ২০১৩) পৌঁছে যাই গহরপুর জামিয়ায়। প্রিন্সিপালের শানদার কক্ষে কথা হয় অনেক বিষয়ে, তবে মূল আলোচ্য ছিলো কওমী মাদরাসা ও কওমী শিক্ষাব্যবস্থা। সুদীর্ঘ আলাপচারিতার সারসংক্ষেপ তুলে ধরা হল। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হাফেজ কেফায়েত।

by ঢাকাবার্তা
মুসলেহুদ্দীন রাজুর সাক্ষাৎকার। গ্রাফিক, গালা

সত্যসমাগত: বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশের প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থা হচ্ছে, কওমী মাদরাসা বা দেওবন্দী ধারার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বৃটিশ উপনিবেশ আমল থেকে এই শিক্ষাব্যবস্থা চালু রয়েছে। দেখা যাচ্ছে, কওমী সিলেবাস অনেক ক্ষেত্রেই প্রাচীনকালের প্রণীত রীতির ওপর বহাল রয়ে গেছে। এই সিলেবাস বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাই।

মুসলেহুদ্দীন রাজু: বাংলাদেশের কওমী মাদরাসাগুলো একক কোনো সিলেবাসের আওতাভুক্ত নয়। তাছাড়া কওমী মাদরাসার একাধিক বোর্ড রয়েছে। একেক বোর্ড একেক ধরনের সিলেবাস অনুসরণ করে। আবার বোর্ডের আওতাভুক্ত এমন কিছু মাদরাসা আছে যারা পূর্ণাঙ্গভাবে ওই বোর্ডের আওতাধীন নয়। যেমন, কওমী মাদরাসাভিত্তিক বড়ো বোর্ড বেফাকভুক্ত এমন কিছু মাদরাসা আছে যারা পুরোপুরিভাবে বোর্ডকে অনুসরণ করে না। দেখা যায়, কোনো মাদরাসা হেদায়াতুন্নাহুর পরীক্ষা বেফাকের অধীনে নেয়। কিন্তু বেফাকে মিজান জামাত এবং নাহবেমীরের পরীক্ষা নেই। সিলেটে অন্য একটা বোর্ড আছে এদারা। তারা হেদায়াতুন্নাহুর পরীক্ষা বোর্ডের (বেফাক) অন্তর্ভুক্ত করেছে। আর অন্য পরীক্ষাগুলো তাদের নিজস্ব শিক্ষাবর্ষ অনুযায়ী হয়। এছাড়া এখানে আরো একটি বোর্ড আছে। এভাবে কওমী মাদরাসার বোর্ডগুলোর ক্ষেত্রে দেখা যায়, সব শিক্ষাবর্ষেই বোর্ড পরীক্ষা রয়েছে। অথচ জেনারেল শিক্ষাবোর্ডের ক্ষেত্রে সব বোর্ড একই নিয়ম ফলো করে। তাদের অষ্টম শ্রেণিতে ফাইনাল পরীক্ষা হয়। মাঝে বিরতির পর আবার এসএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়, অথচ আমাদের মাদরাসা বোর্ডগুলো এমন নয়। এবং বিষয়টি নিয়ে তারা খুববেশি মনযোগী বলেও অনুমিত হয় না। একেক বোর্ড থেকে একেকটি কিতাব নিয়ে তারা নিজের ইচ্ছেমত মিশ্র একটি সিলেবাস গঠন করেছেন। কিছুটা আমার যা মনে চায় এরকম। ইদানীং আরেকটা বিষয় লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে, সেটা হল, জেনারেল সিলেবাস ফলো করা। এতে করে দেখা যায়, ওই সিলেবাসের প্রায় পুরোটাই মাদরাসায় পড়ানো হয়। এতে করে একজন শিক্ষার্থী একই সঙ্গে দুই ধরনের পাঠ্যপুস্তকে মনোযোগ দিতে বাধ্য হচ্ছে।

সত্যসমাগত: মাদরাসায় বাংলা, ইংরেজি ও গণিতের মত যে বিষয়গুলো পড়ানো হয় তা কি সরাসরি জেনারেল পাঠ্যবই থেকে নেওয়া হয়েছে, নাকি মাদরাসা বোর্ডের মুদ্রিত বই আছে?

মুসলেহুদ্দীন রাজু: এ সব বিষয়ে বেফাকের নিজস্ব পাঠ্যবই রয়েছে। তবে হ্যাঁ, লিখিত এই বইগুলোর ভেতরগত এবং পাঠ-পদ্ধতিগত কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। জেনারেল লাইনে অনেক গবেষণা করে বই ও বইয়ে লিখিত বিষয়গুলো একটা গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে নিয়ে আসতে পেরেছে। ক্রমান্বয়ে তাদের বইগুলো ভাষা ও বিষয়গতভাবে সমৃদ্ধও হচ্ছে। পক্ষান্তরে এসব বিষয়ে আমাদের সেরকম কোনো গবেষণা নেই। আর সময়ের সঙ্গে সময়ের প্রয়োজনে এগুলো আপডেটও করা হয় না।

সত্যসমাগত: এ ব্যাপারে বেফাক কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না কেন?

মুসলেহুদ্দীন রাজু: সিলেবাস সংস্কার ও সংশোধনের জন্য বেফাকের আলাদা একটা কমিটি আছে। যাদেরকে বলা হয় ‘নেসাব কমিটি’।

সত্যসমাগত: তারা কি কাগজ-কলমে কমিটি, না কোনো ফিল্ডওয়ার্ক করে?

মুসলেহুদ্দীন রাজু: কমিটিতে কর্মঠ লোক থাকা দরকার। ‘নেসাব কমিটি’তে যারা আছেন তারা সকলেই অনেক বড়ো ও প্রখ্যাত হওয়ার কারণে নিজস্ব কাজে তাদের অনেক ব্যস্ততা থাকে। এ কারণে সিলেবাস নিয়ে তারা পর্যাপ্ত সময় দিতে পারেন না। বইয়ের ওপর গবেষণা, আদ্যোপান্ত পাঠ এবং জেনারেল বইগুলোর সঙ্গে তুলনা করে নতুন আঙ্গিকে সিলেবাস তৈরি করার জন্য যে পরিমাণ সময় ও সুযোগের প্রয়োজন তাদের পক্ষে তা দেওয়া সম্ভব নয়।

সত্যসমাগত: এ ক্ষেত্রে তো বিজ্ঞ তরুণআলেমদের কাজে লাগানো যেতে পারে?

মুসলেহুদ্দীন রাজু: হ্যাঁ, বড়োদের নিয়ন্ত্রণে রেখেই তরুণদের মধ্যে তুলনামূলক যারা একটু অভিজ্ঞ এবং পাঠ্যপুস্তক সচেতন আলেম রয়েছেন, তাদেরকে যদি এ দ্বায়িত্বভার দেওয়া যেত তাহলেও হত। কিন্তু সিলেবাস সংস্কার ও আধুনিকায়নের এই ফুরসতটুকু আমাদের নেই। তিনবছর আগে এক মিটিংয়ে আমি এ ব্যাপারে কথা তুলেছিলাম। শ্রেণির নামকরণ নিয়েও তখন কিছু কথা বলেছিলাম। আমরা এখনো মাদরাসার শ্রেণিগুলোকে ‘আউয়াল, দুয়াম, ছুয়াম, চাহরম, পাঞ্জম’ ইত্যাদি উর্দু বা ফার্সি ভাষায় চিনি এবং চিহ্নিত করি। এতে করে বাচ্চারা মাদরাসায় ভর্তি হয়ে শাব্দিক বিভ্রাটে পড়ে। সে প্রথম শ্রেণি বললে হয়তো চিনতো। ক্লাস ওয়ান বললেও সমস্যটা হত না। আমি এটাই বলতে চেয়েছি। আমাদের সন্তানরা যেহেতু বাংলায় অভ্যস্ত সেখানে ক্লাসের নাম বাংলায় হওয়া তো স্বাভাবিক ব্যাপার। শিক্ষার মৌলিকত্বের দিকে তাকিয়ে আরবীও হতে পারে। কিন্তু উর্দু বা ফারসী ভাষায় হওয়াটা আবশ্যক নয়। আর এখনকার অভিভাবকরা যেহেতু অনেকটা কিন্ডারগার্টেনমুখী, তাই প্রাথমিক মাদরাসাগুলো কিন্ডারগার্টেনের আদলে করলে বেশি ভালো হয়। এতে মাদরাসার মূল উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হওয়ার তো কোনো কারণ দেখছি না।

সত্যসমাগত: আমাদের মাদরাসা লাইনের শিক্ষাবর্ষের টোটাল যে সময়কাল অর্থাৎ শিক্ষাবর্ষ, এটার তো অনেক রকমফের। জেনারেলে যেটা আছে, ক্লাস এইট পর্যন্ত একটা স্টেপ। তারপর ক্লাস টেন পর্যন্ত আরেকটা স্টেপ। এখানে কোনো লং বা শর্টের ব্যাপার নেই। কিন্তু আমাদের মাদরাসা শিক্ষার ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে এর বিপরীত। একেক মাদরাসায় একেক রকমের নিয়মনীতি। কোথাও তেরো বছরে দাওরা পড়াচ্ছে, আবার কোথাও ছয় বা সাত বছরে। এই যে বিষয়টা, এটা আপনি কীভাবে দেখেন?

মুসলেহুদ্দীন রাজু: এখানে একটা বড়ো কারণ হল, বাধ্য-বাধকতার একটা বিষয় আছে। জেনারেল শিক্ষায় সরকারকর্তৃক বিধিবদ্ধ নিয়ম রয়েছে। ওই নিয়মনীতি মেনে চলতে তারা বাধ্য থাকে। কিন্তু আমাদের সেটা নেই। তাই আমরা শিক্ষাবর্ষের সময়টা নিজের মত করে বাড়াতে-কমাতে পারি। আর দ্বিতীয়ত, আমরা এ ব্যাপারে কেউ কাউকে মানি না। না মানারও একটা কারণ আছে। আমরা কাকে মানব, কীভাবে মানব? যাকে মানব তার কথা, যুক্তি, পদ্ধতি ও প্রকল্প তো অন্তত গবেষণামূলক ও গ্রহণযোগ্য হতে হবে। এমনটি আমাদের মাঝে নেই বলেই সবাই নিজের মত করে চিন্তা করে এবং শিক্ষাবর্ষও সে অনুযায়ী কম-বেশি হয়ে থাকে। সিলেবাসেও একই বিষয় দেখা যায়। আমি মনে করি, কওমি মাদরাসায় কয়েক বছরের মধ্যে যদি আমূল একটা পরিবর্তন না আসে, তবে কওমি শিক্ষাব্যবস্থা ভয়াবহ সংকটে পতিত হবে।

সত্যসমাগত: বেফাকের বর্তমান সভাপতি আল্লামা আহমদ শফী এবং মহাসচিব মাওলানা আবদুল জব্বার সাহেব কতো বছর ধরে এ পদে বহাল আছেন?

মুসলেহুদ্দীন রাজু: সভাপতি পদে আল্লামা আহমদ শফী সাহেব ৮ বছর এবং মহাসচিবের পদে মাওলানা আবদুল জব্বার সাহেব প্রায় ৩০-৩৩ বছর হবে আছেন।

সত্যসমাগত: মহাসচিবের পদে দীর্ঘকাল ধরে একজনের বহাল থাকার কারণ কি এটাই যে, তার চেয়ে যোগ্যব্যক্তির সন্ধান পাওয়া যায়নি?

মুসলেহুদ্দীন রাজু: না সে জন্য নয়। যেহেতু এটা একটা পাবলিক প্রতিষ্ঠান। এখানে কিছু নিয়ম-নীতি রয়েছে। বেফাকের মহাসচিব হতে হলে নিয়ম হল, রাজনীতিমুক্ত ব্যক্তিত্ব হতে হবে। কোনো দল করা যাবে না। দ্বিতীয়ত তাকে ফুলটাইম সময় দিতে হবে। তো এ নিয়মের আলোকে আগ্রহীদের মধ্যে তাকেই পাওয়া গিয়েছিল। তিনি দলমুক্ত লোক এবং পুরো সময়টা বেফাকে দিতে পারেন।

সত্যসমাগত: আপনার কি মনে হয় আবদুল জব্বার সাহেব এখন যে সার্ভিসটা দিচ্ছেন, তা বেফাক ও বেফাকের আয়ত্বাধীন সকল প্রতিষ্ঠানের জন্য যথেষ্ট?

মুসলেহুদ্দীন রাজু: বেফাকের এ দীর্ঘসময়ে আবদুল জব্বার সাহেবের অনস্বীকার্য অনেক ত্যাগ রয়েছে এটি যেমন সত্য, তেমনি সত্য হল, বর্তমান সময়ে একটা বোর্ড পরিচালনা জন্য যে ধরনের পরকিল্পনার দরকার রয়েছে তা আমাদের নেই।

সত্যসমাগত: বর্তমানে বাংলাদেশে সবমিলে মাদরাসা বোর্ড কয়টি?

মুসলেহুদ্দীন রাজু: আঞ্চলিকসহ পুরো দেশে মোট কয়টি বোর্ড আছে তা আসলে বলা মুশকিল। মাত্র পাঁচটি মাদরাসা নিয়েও একটা বোর্ড পরিচালিত হচ্ছে এমন নজির রয়েছে। পার্বত্য আঞ্চলেও একটা একক বোর্ড আছে, তালিমুল কোরআন বোর্ড। এমন কমবেশি শতাধিক বোর্ড তো আছেই। তবে শতাধিক মাদরাসা নিয়ে গঠিত এমন বোর্ড দশ কি বারোটার মত হবে।

সত্যসমাগত: এই সব বোর্ড একত্রিত করে একক নিয়ন্ত্রণে নেওয়া সম্ভব? জেনারেলে তো বিভাগীয়ভাবে একাধিক বোর্ড আছে ঠিক, যেমন- বরিশাল, রাজশাহী, সিলেট ইত্যাদি। তারপরও তাদের সেন্ট্রাল একটা অথরিটি আছে। সেটা তাদের মানতে হয়। কিন্তু আমাদের মাদরাসা বোর্ডগুলোর ক্ষেত্রে এমনটি নয় কেন?

মুসলেহুদ্দীন রাজু: এর প্রাথমিক কারণ হল, বেফাক নামে আমাদের বড়ো ও পুরনো বোর্ডটিতে শীর্ষ পর্যায়ে যারা রয়েছেন, তারা সমকালীন ও আধুনিক বিষয়ে ধারণা রাখেন কম। তাদের মন-মানসিকতা এবং গবেষণা আধুনিক এবং যথার্থ হলেই হয়তো এমনটি হতে পারে। সভাপতি পদে আল্লামা আহমদ শফী সাহেব আছেন, তিনি বয়োজ্যেষ্ঠ এবং ব্যস্ত মানুষ। শিক্ষা-নেসাব নিয়ে পরামর্শ করা এবং সে অনুযায়ী সংস্কার করার মত লম্বা সময় তার হয়ে ওঠে না। দীর্ঘসময় নিয়ে বসলে হয়তো একটা সমাধান আসত। শিক্ষার মূল নেসাব নির্ধারণের ক্ষেত্রে অত্যন্ত ধীরস্থিরভাবে কাজ করতে হবে। প্রয়োজনে তিনদিন বা সপ্তাহব্যাপী বৈঠক করে একটা সুষ্ঠু-সুন্দর এবং স্থায়ী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কিন্তু এটা আমাদের বড়োদের কারণে হয়ে ওঠে না। আবার নতুনদের কথা যে চিন্তা করব তাও নয়। কারণ, নতুনদের মধ্যে যেমন একদিকে সম্ভবনা আছে, তেমন অপরিপক্বতার আশঙ্কাও আছে সমানভাবে।

সত্যসমাগত: আপনি বলতে চাচ্ছেন, আগের আলেমরা মানুষের কাছে যেমন গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছেন, সেরকম গ্রহণযোগ্য আলেম এখন আর পাওয়া যাচ্ছে না?

মুসলেহুদ্দীন রাজু: পাওয়া যাচ্ছে না ঠিক তা নয়। তবে গ্রহণযোগ্যতা মানুষের কাছে দু’ভাবে নির্ণীত হয়। একটা হল, খালেস আল্লাহঅলা হয়ে যাওয়া। যার দুনিয়াবি কোনো কাজ নেই। সর্বদা তাকওয়া পরহেজগারি অবলম্বন করা। তিনি দুআয় হাত তুললে সকলেই সে দুআয় শরিক হওয়াকে সৌভাগ্য মনে করে। তার নির্দেশ এলাকার সবাই ভক্তিভরে পালন করে। এ ক্ষেত্রে সকলেই তাকে সম্মান করে। সবার কাছেই তার গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়। এমন বুজুর্গ ও গণমানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য আল্লাহর বান্দা বাংলাদেশে এখন নেই বললেই চলে। আরেকটি বিষয় হল, সামাজিক জ্ঞান সমৃদ্ধ আলেম। এটাও এখন পর্যন্ত পুরোপুরিভাবে পাওয়া যাচ্ছে না। যেমন আজকে আপনি পাঁচটি সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে আলোচনায় বসলেন। দেখা যাবে, কওমি মাদরাসায় যারা পড়েছে তারা ওখানে যেয়ে নিজেদের খাপ খাওয়াতে পারছে না। তবে আমি আশাবাদী, আলহামদুলিল্লাহ তরুণ আলেমরা ইতোমধ্যে অনেক দূর এগিয়েছে।

সত্যসমাগত: তাহলে বেফাক সামনে অগ্রসর হতে পারছে না শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গের কারণে?

মুসলেহুদ্দীন রাজু: আমি তাই মনে করি। তারা যদি বিভিন্ন কাজে বেশি ব্যস্ত না হয়ে এ দিকটায় সময় দিতেন, সব বোর্ডভুক্ত মাদরাসাগুলো পরিদর্শনে যেতেন, কোথায় কী পড়ানো হয়, কীভাবে পড়ানো হয় মনিটরিং করতেন, মোটকথা- কেন্দ্র থেকে যদি গাইডলাইন থাকত, তাহলে বোর্ডের দুর্বলতা যেমন চিহ্নিত হত এর একটা সঠিক সুরাহাও পরামর্শের মাধ্যমে বের হয়ে আসত।

সত্যসমাগত: কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে গেলে তো প্রচুর অর্থ ও লোকবলের দরকার। বেফাক বোর্ডে কি এই পরিমাণ অর্থ ও লোক নিয়োগের ব্যবস্থা হতে পারে?

মুসলেহুদ্দীন রাজু: সম্ভব! বেফাকের নিজস্ব ফান্ডে অর্থের কোনো অভাব আলহামদুলিল্লাহ নেই। লোকও আছে। কমিটি ছাড়াও কমবেশি ষাটজনের মত কর্মকর্তা ও কর্মচারী রয়েছে। যদিও তা খুব বেশি নয়। কারণ বেফাকের মত বড়ো বোর্ড যার আওতায় প্রায় পাঁচ হাজার মাদরাসা সেখানে তার অফিসে ষাটজন লোক খুব বড়ো অংক নয়। তথাপি এই ঘাটতি পূরণ করা কোনো সমস্যা না। সমস্যা হল, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অভাব। আমাদের বেফাকের পরিকল্পনাটা অনেকটা ভ্রামমাণ। যখন যেটা দরকার পড়ে, সেটা নিয়ে আলোচনায় বসি। আমাদের চিন্তা-ভাবনা সুদূরপ্রসারী হলে এমনটা হত না। যে কারণে মাদরাসার ছাত্রদের আমরা সমাজের সর্বস্তরে সেবার জন্য নিয়োগ দিতে পারি না। একটা ঘটনা বলি। একবার আমরা সফরের উদ্দেশ্যে সিলেট রেলস্টেশনে যাই। চা খাওয়ার জন্য স্টেশনের এক দোকানে ঢুকি। ওই সময় চায়ের অর্ডার নেওয়া বন্ধ। আমরা ফিরে আসতাম, কিন্তু এমন সময় একটা ছেলে নিজের আগ্রহে আমাদের চা বানিয়ে পান করায়। আলাপচারিতায় জানলাম ছেলেটি মাদরাসায় কিছু লেখাপড়া করেছে। ঘটনাটা বলার কারণ হল, এই এখানে আমাদের পরিচিত লোক থাকার ফলে আমরা সর্বোচ্চ সুবিধাটা পেয়েছি। এমনিভাবে আমাদের পরিকল্পনাটা যদি আরো ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী হত, আজ এ ছেলেটা যদি সচিবালয়ে থাকত বা যদি ইউএনও হত অথবা সরকারি বড়ো কোনো পদে অধিষ্ঠিত থাকত, তবে সেখান থেকে আমরা সর্বোচ্চ সুবিধাটা নিতে পারতাম।

সত্যসমাগত: কথা হল, স্বীকৃতি পেলেও সচিব বা জজ হওয়ার মত অবস্থায় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা পৌঁছেনি। সচিব বা জজ হতে হলে যে বিষয়গুলো অধ্যয়ন করতে হয়, তা আমাদের সিলেবাসে নেই।

মুসলেহুদ্দীন রাজু: হ্যাঁ, আপনার কথা ঠিক আছে। তবে ক্লাস এইট পর্যন্ত আমাদের সিলেবাসের সঙ্গে জেনারেল সিলেবাসের খুব একটা পার্থক্য নেই। বাকি আমাদের স্বীকৃতিটা যদি হয়ে যায়, তখন বাকিটাও হয়ে যাবে। আমি মনে করি বাইরের ছেলেদের চেয়ে আমাদের ছেলেরা অনেক বেশি মেধাবী ও পরিশ্রমী। আমরা অনেকে বলে থাকি, পরিবারে ছেলেটা একটু দুষ্টু প্রকৃতির হলে তাকে মাদরাসায় পাঠায়। কথাটার বাস্তবতা আছে। সিলেট সদর থানা মাদরাসার দুই ছেলে গতবার সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল। ওই থানায় তারা প্রথম স্থান অধিকার করেছে। এটা শুধু এখানে নয়। সবখানেই আমাদের ছেলেরা জেনারেল বিভাগগুলোতে পরীক্ষা দিয়ে সন্তোষজনক ফলাফল করছে। জেনারেলের ছেলেরা ক্লাস ও কোচিং-এর সময়টুকুই লেখাপড়া করে। কিন্তু আমাদের ছেলেরা দিনরাত ২৪ ঘণ্টাই লেখাপড়া নিয়ে থাকে। আমি বলতে চাচ্ছি, আমাদের ছেলেরা ঠিকই আছে। দরকার শুধু সিলেবাসটা আপডেট করা। এতেই চলবে। এক্ষেত্রে আমাদের ও সরকারের মধ্যে একটা সমঝোতায় আসা দরকার। তার আগে সরকারের কিছুই মানব না, এই মনোভাব পরিহার করতে হবে। কেননা, সবসময় বিদ্রোহী হয়ে বসবাস করা যায় না। তাহলে সমাজ ছেড়ে বনে-জঙ্গলে একা একা বসবাস করা লাগবে। ইসলামও এমনটা বলেনি। তাই কওমী মাদরাসার সনদ স্বীকৃতির ব্যাপারে আমার মনে হয়, সরকার আমাদের কিছু দাবি মেনে নিক আর আমরাও সরকারের কিছু বিষয় বিবেচনায় নেই। মাঝামাঝি একটা অবস্থানে থেকে আমাদের সিলেবাসের কাঠামোগত পরিবর্তন করি। এমন হতে পারে, সরকার চারটি বিষয় নির্ধারণ করে দেবে আর বাকি চারটা আমরা নির্ধারণ করব। তাহলে আমার মনে হয় কোনো সমস্যা থাকে না।

সত্যসমাগত: এখন তো একদিকের চাপ। আপনার কথা মত সিলেবাস তৈরি হলে তখন তো দুদিক থেকেই চাপ থাকবে। এক সরকারের চাপ আবার মাদরাসার চাপ। আর বড়ো কথা হল, সরকারি চাপটাতো মূলত সরকারের একার নয়, বহির্বিশ্বেরও একটা চাপ থাকে মাদরাসাগুলোর ব্যাপারে। বিশেষ করে নাইন ইলেভেনের পর দেশের কওমী মাদরাসাগুলো নিয়ে বহির্বিশের যে আগ্রহ, এ বিষয়গুলো তখন কীভাবে সামাল দেবেন?

মুসলেহুদ্দীন রাজু: বুঝতে পেরেছি, আপনি বহির্বিশ্বের আগ্রহ বলতে কওমী মাদরাসায় তাদের নিয়ন্ত্রণটা বোঝাতে চেয়েছেন। আমি বলব, তারা নিয়ন্ত্রণটা করতে চায় মূলত এ জন্যে, তারা মনে করে আমরা এসব মাদরাসায় ছাত্রদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এ জন্য আমার মতে এখানকার মাদরাসা সব বিষয়-আশয় ওপেন করে দেওয়া হোক। সিলেবাসে কী আছে, ছাত্রদের কী পড়ানো হয়, মাদরাসার ভেতরে কী হয় না হয়, সব বিষয়গুলো পাবলিকের সামনে উন্মুক্ত করে দেওয়া হোক। তখন আর বলতে পারবে না, কওমী মাদরাসায় জঙ্গি ট্রেনিং দেওয়া হয়। এটা প্রতিটি মাদরাসা কর্তৃপক্ষের নিজস্ব দায়িত্ব।

সত্যসমাগত: আপনার মাদরাসার ক্ষেত্রে কি আপনি এমনটি করছেন?

মুসলেহুদ্দীন রাজু: আমার মাদরাসার ব্যাপারে এলাকার পুলিশপ্রশাসন থেকে শুরু করে সমাজের সর্বস্তরের জনগণ ভালো করে জানে। সবার কাছে আমাদের রিপোর্ট ভালো। সবচে মজার বিষয় হল, যখন ‘শাপলা ট্রাজেডি’র পর পুরো দেশ নিস্তব্ধ ছিল। ওই সময় আমাদের এলাকায় ওই গণহত্যার প্রতিবাদে মিছিল হয়েছে। সেই মিছিলে ওলামা-তলাবার সঙ্গে এলাকার সর্বস্তরের জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছিল। এর বিপরীতে ছাত্র ছিল খুবই কম। শুধু তাই নয়, আমরা মাইকে শাপলা চত্বরে ‘অপারেশন ফ্লাশআউট’-এ শহীদদের জন্য দুআও করেছি। এবং মাদরাসা থেকেই আমরা ওই গণহত্যার নিন্দা জানিয়েছি। তাই আমার মত হচ্ছে, আন্দোলনের জন্য ছাত্রদের নয় বরং সাধারণ জনগণের ওপর নির্ভরশীল হতে হবে। সেটা আমরা পেরেছিলাম। কারণ, এলাকায় জনসাধারণের মাঝে আমাদের ব্যাপারে ইতিবাচক ধারণা রয়েছে।

সত্যসমাগত: সামাজিক কর্মকাণ্ডে আলেমদের সম্পৃক্ততা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?

মুসলেহুদ্দীন রাজু: সামাজিক কর্মকাণ্ডে আমি মনে করি ওলামাদের সম্পৃক্ততাটাই অনেক বেশি। আমাদের মুরুব্বী যারা রয়েছেন তাদের বয়স বৃদ্ধির কারণে হয়তো অনেক জায়গায় যেতে পারেন না। তবে তরুণরা অবশ্যই সমাজকল্যাণে এগিয়ে। ছোট্ট একটা দৃষ্টান্ত দেই। এই যে, মাদরাসার সামনে একটি ব্রিজ দেখতে পাচ্ছেন, সেখানে আগে কোনো ব্রিজ ছিল না। বরং বাঁশের সাঁকো ছিল। ঝড়-বৃষ্টিতে তা ভেসে চলে যেত। এর ফলে এলাকার মানুষ চলাচল সংকটে ভুগতেন। আব্বাজান তখন ছাত্রদের নিয়ে পুনরায় সাঁকো তৈরি করে চলাচলের ব্যবস্থা করে দিতেন। তার অবদানেই এখানে আজ ব্রিজ তৈরি হয়েছে। এমনিভাবে শুধু ব্রিজ নয়, সব সমস্যা সমাধানে এখনো এ এলাকায় আলেমদের প্রাধান্য দেওয়া হয়। হ্যাঁ, আমরা সেন্ট্রালি সাংগঠনিকভাবে কাজ করতে পারছি না। কিন্তু আঞ্চলিক পর্যায়ে ঠিকই এখন কমবেশি সামাজিক সমস্যাগুলোতে ওলামারা অবদান রাখছেন। আরও কিছু প্রমাণ দিই। ৫ মের পরে ‘শাপলা চত্বর’-এর ঘটনায় নরসিংদী পর্যন্ত যারা আহত এবং শহীদ হয়েছিলেন তাদের দেখতে গিয়েছিলাম। ওখানে তরুণ আলেমরা মিলে একটা সমিতি করেছে। তারা অনেক এতিম ছেলেকে বেতন দিয়ে লেখাপড়া চালিয়ে নিচ্ছে। উনারা এসব হতাহতের কাউকে কাপড় দিয়ে, কাউকে ঔষুধ বা অর্থ দিয়ে সহায়তা করেছে। সামাজিক ও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে আরও যা যা করা দরকার সবই তারা করেছে। এছাড়া সবচেয়ে বড় যে সেবাটা সমাজে আলেমরা দিচ্ছে, তাহল মানুষকে সঠিক পথের দিশা দেওয়া, ভালো কাজের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা। সপ্তাহে একদিন শুক্রবার মসজিদে মসজিদে ইমামরা সামাজিক সমস্যা-সংকট ও মানুষের জীবনযাপনের পদ্ধতি নিয়ে যে আলোচনা করেন তা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে এখনো সামাজিক শৃঙ্খলা টিকে আছে। এটা না থাকলে অল্প দিনেই সমাজ বিশৃঙ্খল হয়ে যেত। এ দিকটি লক্ষ্য করলে স্বীকার না করে উপায় নেই, আলেমরাই সামাজিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় বড়ো অবদান রাখছেন। কিন্তু একে বড় করে দেখা হচ্ছে না বিধায় ওলামাদের অবদানগুলো চোখে পড়ছে না। আরও একটা ব্যাপার হচ্ছে, অন্যরা সমাজের জন্য পাঁচ টাকা খরচ করলেও তা মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার করে, সে জন্য আমরা তাদের অবদানটা দেখি। কিন্তু ওলামারা কাজ করেন এখলাসের সঙ্গে। তাই তাদের কাজগুলো প্রচারণা পায় কম। তবে আমি যতটুকু দেখেছি, তাতে তরুণ ওলামারা আগামীর সম্ভাবনা।

সত্যসমাগত: আপনি যেসব সম্ভাবনাময় তরুণ আলেমদের কথা বলছেন তারা কোনো কেন্দ্রের অধীনে থেকে ঐক্যবদ্ধ ও পরিকল্পিতভাবে অগ্রসর হচ্ছে না। বরং যে যার মত করে এগুতে চাইছে। এদের মধ্যে সমন্বয় ঘটান যাবে কীভাবে, আপনার কী মত?

মুসলেহুদ্দীন রাজু: এখন গ্লোবালাইজেশনের যুগ। বর্তমানে বিশ্ব হাতের মুঠোয়। এ ক্ষেত্রে আমি মনে করি, আমাদের ছেলেদের মন-মানসিকতা দিন দিন প্রশ্বস্ত হচ্ছে। আগে একটা সময় ছিল, যখন আমাদের ছেলেরা বাইরের জগত সম্পর্কে কোনো ধারণাই রাখত না। ইন্টরনেট-ফেসবুক কাকে বলে, বুঝত না। কিন্তু এখন তারা অনেক এগিয়েছে। পারিপার্শ্বিক দায়বদ্ধতা থেকে তারা সবকিছু জানতে শিখছে। শাহবাগ আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। ব্লগ ও ব্লগার নামে অনেক কিছু উদ্ঘাটিত হয়েছে। অথচ আগে আমরা অনেকেই ব্লগ কী তা বুঝতাম না। কিন্তু এখন ছেলেরা এ নিয়ে চর্চা করেছে।

সত্যসমাগত: তাদের এই এগিয়ে যাওয়াটা যেমন ভালো, তেমনি এর একটা খারাপ দিকও তো আছে।

মুসলেহুদ্দীন রাজু: সব জিনিসেরই ভালো-খারাপ দুটি দিক রয়েছে। ইন্টারনেটের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই। এর জন্য উত্তম হল, নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। খারাপ দিক আছে বলে দূরে সরে থাকার পক্ষপাতি আমি নই। বর্তমানে ইন্টারনেট, ফেসবুক ব্যবহারিক জীবনের একটা অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হয়েছে। এর খারাপ দিক বিবেচনা করে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। বরং তার ভালোটাকে কাজে লাগাতে হবে।

সত্যসমাগত: খারাপ দিকগুলো আমরা কীভাবে চিহ্নিত করব?

মুসলেহুদ্দীন রাজু: এ জন্য প্রতিটি মাদরাসায় অন্যান্য সাবজেক্টের মত তথ্য-প্রযুক্তির সাধারণ জ্ঞান দেওয়া আবশ্যক। যাতে সবাই তথ্য-প্রযুক্তির একটা ন্যূনতম জ্ঞান অর্জন করতে পারে। আর এখন তো আমাদের ছেলেরা সমাজিক নতুন নতুন বিষয় জানতে অনেক বেশি আগ্রহী।

সত্যসমাগত: বেফাক কি এ ধরনের প্রশিক্ষণের ব্যাপারে আগ্রহী?

মুসলেহুদ্দীন রাজু: না। এমন কোনো উদ্যোগ বেফাক এখনো নেয়নি। ভবিষ্যতে হয়তো নেওয়া হতে পারে।

সত্যসমাগত: কওমী মাদরাসায় শিক্ষক নিয়োগের ব্যাপারে কিছু বলবেন? একটা ছাত্র দেখা যায় শিক্ষাজীবন শেষ করে কোনো প্রকার প্রশিক্ষণ ছাড়াই সরাসরি শিক্ষকতায় নিয়োগ পায়। অথচ শিক্ষকতার যে প্রাথমিক জ্ঞান অনেকক্ষেত্রে তাদের মধ্যে তাও থাকে না। কীভাবে ছাত্র পড়াতে হয়, তালিম দিতে হয় তা তার জানা থাকে না।

মুসলেহুদ্দীন রাজু: হ্যাঁ, আমারও মনে হয় শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের দরকার আছে। সেখানে মাদরাসা পরিচালনারও একটা কোর্স হতে পারে। মাদরাসা কীভাবে পরিচালনা করতে হয়, শিক্ষকমিটিংয়ে কী কী বিষয় উপস্থাপন করতে হয়, কীভাবে করতে হয়- তার প্রশিক্ষণ না থাকলে একটা ছেলে ছাত্রজীবন থেকে হুট করে শিক্ষকজীবনে এসে কোনো কিছু বোঝা মুশকিল হয়ে পড়ে। কিন্তু মূল সমস্যা হচ্ছে, এখানে ভালো মানের প্রশিক্ষক পাওয়া তো মুশকিল।

সত্যসমাগত: আমার যতদূর মনে পড়ে, অনেক আগে একবার সৈয়দ আলী আশরাফ রহ, থাকাকালীন দারুল ইহসান ইউনিভার্সিটি থেকে এমন একটা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তাছাড়া বিচ্ছিন্নভাবে এ রকম প্রশিক্ষণ ইদানীং অনেক জায়গা হচ্ছেও।

মুসলেহুদ্দীন রাজু: হ্যাঁ, প্রশিক্ষণ হচ্ছে; কিন্তু সে প্রশিক্ষণটা সর্বোচ্চ মানের না। ভার্সনটা অনেক পুরনো। প্রশিক্ষণটা হতে হবে মানসম্পন্ন। যিনি যে বিষয়ে পারদর্শী ওই বিষয়ের প্রশিক্ষণে তাকে আনতে হবে। যেমন ইসলামী ব্যাংকিং ও সাধারণ ব্যাংকিংয়ের মধ্যে পার্থক্যের ক্ষেত্রে উভয়ধারার ব্যাংকিংয়ে অভিজ্ঞ বড় দু’জন বিশেষজ্ঞকে আনা যেতে পারে। এভাবে সববিষয়ের ক্ষেত্রেই বিশেষজ্ঞদেরকে নিয়ে আসতে হবে। তবেই ছেলেদের প্রতিটি বিষয়ের ওপর একটা স্বচ্ছ ও সঠিক ধারণা তৈরি হবে। জেনারেল টিচার্স ট্রেনিংয়েও বিশেষ করে কলেজ লেবেলের ট্রেনিংগুলোতে নির্দিষ্ট কোনো টিচার নেই। যখন যে বিষয় দরকার, সে বিষয়ের ওপর একজন স্পেশালিস্ট নিয়ে আসা হয়। মোটকথা প্রশিক্ষণটা জরুরি। সবক্ষেত্রেই প্রশিক্ষণ লাগবে। এক্ষেত্রে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। এটা হলে সববিষয়ে আমরা আগের চেয়ে আরো কয়েকগুণ বেশি সাফল্য ও অবদান রাখতে পারব।

সত্যসমাগত: পাঠ্যপুস্তক ও পাঠ্যতালিকার ব্যাপারে আমাদের দেশের ওলামাদের সঙ্গে ভারত বা পাকিস্তানের ওলামাদের যে রকম ভালো সম্পর্ক রয়েছে, আরববিশ্বের ওলামাদের সঙ্গে তেমনটা নেই। এর কারণ কী?

মুসলেহুদ্দীন রাজু: একটু কড়া করেই বলি। আমরা দেখি ইদানীং আমাদের ওয়াজ-মাহফিল বা খতমে বুখারীসহ সকল ইসলামী ঘরানার অনুষ্ঠানগুলোতে ভারত বা পাকিস্তানের খ্যতিমানদের দাওয়াত দেওয়া হয়। তাদের পেছনে এই পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয়, যা দিয়ে অনায়াসে একটা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের দুই থেকে আড়াই মাসের বেতন হয়ে যায়। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের দেশেও বড় মাপের অনেক ব্যক্তিত্ব রয়েছেন। আপনি কী কখনো দেখেছেন, ভারত বা পকিস্তানিরা তাদের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। তাদের দেশের বড় কোনো মাহফিলের প্রধান অতিথি বানিয়েছে? আমার তো মনে পড়ে না। এটা আমাদের এক ধরনের অন্ধ্যত্ব। পাকিস্তানে প্রতিবছর কেরাত মাহফিল হয় এবং সেখানে মিসর থেকে কারীদের আনা হয়। দাড়িবিহীন এসব কারী কেরাত পরিবেশন করে। অথচ আমরা জানি, আমাদের ছেলেদের কেরাত এখন বিশ্বমানের। সৌদি ও মিসর গিয়ে তারা প্রথম স্থান অধিকার করে। অথচ পাকিস্তান কি কখনো আমাদের ছেলেদের তাদের কেরাত মাহফিলে দাওয়াত দিয়ে নিয়েছে? এরচে যদি মধ্যপ্রাচ্যের ওলামাদের সঙ্গে বা হারামাইনের ইমামদের সঙ্গে একটা যাতায়াত রাখতাম আরো ভালো হত।

সত্যসমাগত: ভারত-পাকিস্তানের ওলামাদের তো ঠিকই বহির্বিশ্বের ওলামাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। এক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে কেন?

মুসলেহুদ্দীন রাজু: এখন যোগাযোগ কিছুটা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু একটা সময় ছিল আমাদের দেশীয় ওলামাগণ ভারত-পাকিস্তান ছাড়া কিছুই বুঝত না। এদেশে শুধু তাদেরই খবরদারি চলত। এর একটা কারণ ছিল আমাদের লেখাপড়ার মাধ্যমটা তাদের ভাষায়। প্রায় সব কিতাবই তখন পড়তে হত উর্দু নয়তো ফার্সীতে। যে কারণে আমাদের যোগাযোগ তাদের সঙ্গে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এখন আর সেটা নেই। শিক্ষার ক্ষেত্রে উর্দু-ফার্সি এখন আর প্রধান মাধ্যম নয়। আমাদের পাঠ্যতালিকার কমবেশি সব বই-ই এখন বাংলায় লিখিত বা আরবী থেকে সরাসরি বাংলায় অনূতিত। আমরা ধীরে ধীরে সংকীর্ণতা কাটিয়ে উঠছি। তবে হ্যাঁ, এটা অস্বীকার করা যাবে না, বাংলাদেশের ওলামাদের ওপর ভারত-পাকিস্তানের ওলামাদের একটা অনস্বীকার্য অবদান রয়েছে। সম্প্রতি দেওবন্দ মাদরাসার শাইখুল হাদীস আল্লামা আরশাদ মাদানী বাংলাদেশ সফর করেছেন। বেফাককে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেছিলেন, ‘দারুল উলুম দেওবন্দের দরসে নিজামীর ব্যাপারে উসুলে হাশতে গানাহ বলতে যে মূলনীতিকে আমরা ফলো করি সেটি তখনকার সময়ের জন্য প্রযোজ্য।’ এবং তৎকালীন সময়ে সরকারি স্বীকৃতি না নেওয়ার ব্যাপারটা তিনি আরও স্পষ্ট করে বলেন, ‘হাশতে গানাহ যখন তৈরি করা হয়, তখন পরিস্থিতির অনেক কিছুই অনুকূলে ছিল না। ভারতের ভৌগলিক অবস্থান, মুসলমানদের অবস্থা ও রাষ্ট্রব্যবস্থা সবকিছু ভাবতে হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে আপনাদের দেশের অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখন আপনারা সবাই মিলে যেটা করবেন, সেটিই হবে উসুলে হাশতেগানাহ।’ তিনি স্পষ্টভাবেই এ কথা বলেছেন।

সত্যসমাগত: সিলেবাস, স্বীকৃতি যাই বলেন মাদরাসাবোর্ড কর্তৃক সামগ্রিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য তো একটা ইউনিটির দরকার। আপনার কি মনে হয়, আমাদের সেটা যথেষ্ট পরিমাণে আছে?

মুসলেহুদ্দীন রাজু: ইউনিটি বলতে আমার মনে হয় আল্লামা আহমদ শফী সাহেবই যথেষ্ঠ। বাংলাদেশের ওলামারা সবাই তাকে মান্য করে। বাকি যেটা আমি আগেও বলেছি, আমাদের সুনির্দিষ্ট ও সুদূরপ্রসারী প্ল্যানের অভাব রয়েছে। কার্যত আমাদের কোনো মাস্টারপ্ল্যান নেই।

সত্যসমাগত: মাস্টারপ্ল্যানের জন্য তো ইউনিটি লাগবে। সবাই মিলে বসেই একটা প্ল্যান করতে হবে। এ ধরনের কোনো উদ্যোগ আদতে আছে কি?

মুসলেহুদ্দীন রাজু: হ্যাঁ, আছে। এটা আমাদের বেফাকে আছে। তবে বেফাকের প্রধান কর্মকর্তারা প্রায় সকলেই বয়স্ক এবং মাজুর। একমাত্র আমার মত আরও দু’একজন পাবেন কম বয়সী, যুবক। বাকি অনেকে বয়স্ক এবং অসুস্থ।

সত্যসমাগত: এক্ষেত্রে করণীয় কী?

মুসলেহুদ্দীন রাজু: এ ক্ষেত্রে আমরা একটা জিনিস করতে পারি, সেটা হল, তাদের তত্ত্বাবধানে এমন কিছু আগ্রহী তরুণ আলেম নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে, যারা বোর্ডের কর্মসূচি বাস্তবায়নে আন্তরিকভাবে সচেষ্ট হবে। অর্থাৎ তারা উপদেষ্টা হিসেবে থাকবেন কিন্তু কাজ করবে তরুণরা।

সত্যসমাগত: মাঠে-ঘাটে তো ইদানীং বহু ইফতা ও উচ্চতর গবেষণা প্রতিষ্ঠান দেখা যায়। এসব রেডিমেড মাদরাসা ও মাদরাসা থেকে দেওয়া সার্টিফিকেটের ব্যাপারে বেফাক বোর্ড কোনো উদ্যোগ নিয়েছে?

মুসলেহুদ্দীন রাজু: আসলে বেফাক নামে যে শিক্ষাবোর্ডটি আছে আমাদের, সেটা মূলত সর্বাংশে শিক্ষাবোর্ড এখনো হতে পারেনি। নামেই শুধু শিক্ষাবোর্ড। মূলত এর কার্যক্রম বলতে হচ্ছে, বর্তমানে শুধু পরীক্ষা নেওয়া। বলা যায় পরীক্ষাকেন্দ্রিক একটি বোর্ড এটি।

সত্যসমাগত: ইফতা বিভাগের পরীক্ষাও কি বেফাকের আওতাভুক্ত?

মুসলেহুদ্দীন রাজু: না, ইফতা কোনো বোর্ডের আওতাভুক্ত বিভাগ নয়। এটা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে খোলা হয়। এর জন্য বোর্ড থেকে অনুমোদন নেওয়া লাগে না। এর পরীক্ষাগুলোও হয় প্রাতিষ্ঠানিক, যার যার মত করে।

সত্যসমাগত: হুজুরদের জীবনযাত্রার মান নিয়ে কিছু বলুন। মাদরাসা থেকে যে পরিমাণ সম্মানি বা ভাতা দেওয়া হয়, প্রয়োজনের তুলনায় তা যথেষ্ট?

মুসলেহুদ্দীন রাজু: বর্তমানে কওমি মাদরাসায় মাসিক সম্মানি যেটা দেওয়া হয় সেটা মনে হয় একেবারে কম নয়। আরেকটা কথা হচ্ছে, এর মাঝে একটা বরকতও আছে। দেখবেন ফ্যামিলি অনেক বড়, খরচও অনেক বেশি। কিন্তু আল্লাহর মহিমা, বেতনের এই টাকা দিয়েই সংসার ভালোভাবে চলে যাচ্ছে। বাড়তি কোনো ঋণ নেই, দেনা নেই। এই বাজারে যেটা সত্যিই বিস্ময়ের।

সত্যসমাগত: এবার আপনার মাদরাসা সম্পর্কে কিছু বলুন।

মুসলেহুদ্দীন রাজু: আলহামদুলিল্লাহ, চলছে। ফলাফলের দিক থেকে সিলেটের অন্যান্য মাদরাসার চেয়ে আমাদের মাদরাসা এগিয়ে আছে।

সত্যসমাগত: সিলেট ও সিলেটের ওলামাদের নিয়ে যদি কিছু বলতেন।

মুসলেহুদ্দীন রাজু: সিলেটে আগে যেমন আলেমরা সর্বসাধারণের সঙ্গে সম্পৃক্ত ও পরিচিত ছিলেন, এখন সেটা নেই। আগের আলেমদের সাধারণ জনগণ চিনত। যেমন আমার আব্বাকে সিলেট এলাকার সবাই চিনত। শুধু চিনত না ভালো সম্পর্কও ছিল। এমনিভাবে শায়খে কৌড়িয়া রহ. এবং দরগার ইমাম রহ.-কে সাধারণ পাবলিক চিনত। কিন্তু এখনকার আলেমদেরকে অতো বেশি চিনে না। তাদের পাবলিক পরিচিতি কম।

সত্যসমাগত: সিলেটের আলেমদের পারস্পারিক সম্পর্কটা কেমন?

মুসলেহুদ্দীন রাজু: সবাই তো কাজকর্মে ব্যস্ত। দেখা যাচ্ছে, কেউ হয়তোবা কোনো মাদরাসার প্রিন্সিপাল। তিনি তার মাদরাসা নিয়ে ব্যস্ত। কেউ শিক্ষক। তিনি ছাত্র নিয়ে ব্যস্ত। মোটকথা দেখা-সাক্ষাতের জন্য যে পরিমাণ সময় ও সুযোগের প্রয়োজন তা কারোরই হয়ে ওঠে না। আমি মাঝে মধ্যে উদ্যোগ নিই। বেফাক সংশ্লিষ্ট ও বেফাকের বাইরের লোকদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত ও মত বিনিময়ের চেষ্টা করি।

সত্যসমাগত: আপনাদের এখানে মাদরাসার সংখ্যা কত?

মুসলেহুদ্দীন রাজু: আমাদের ইউনিয়নে ছোট-বড় মিলে ১৯টি মাদরাসা এবং পুরো সিলেট জেলায় প্রায় ছয়শর অধিক মাদরাসা রয়েছে।

সত্যসমাগত: এই ছয়শর অধিক মাদরাসার আলেমদের মধ্যে যোগাযোগের নির্দিষ্ট ব্যবস্থা?

মুসলেহুদ্দীন রাজু: ওইভাবে নেই। তবে প্রাচীন ও প্রসিদ্ধ যে দশ-বারোটি মাদরাসা আছে, সেসব মাদরাসার মুরুব্বীদের সঙ্গে মাঝে মাঝে সাক্ষাৎ করি। তাদের সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক রয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মাঝে মধ্যে তরুণ আলেমদের নিয়ে চায়ের আয়োজন করি। তবে এ ক্ষেত্রে আমি আগের কথাই বলব, সেটা হল আমাদের ছেলেদের লেখাপড়া শেষে শিক্ষক হওয়ার আগে শিক্ষক প্রশিক্ষণ কোর্স করা দরকার। সেখানে সবার সঙ্গে যোগাযোগরক্ষার ব্যাপারটাও শেখানো হবে। তাহলে আমাদের কমিউনিটিটা আরও শক্ত ও মজবুত হবে।

সত্যসমাগত: এলাকায় কওমী ধারার রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর প্রভাব কেমন?

মুসলেহুদ্দীন রাজু: আমাদের সিলেট এলাকায় একটা সময় কওমী ধারার সংগঠনগুলো বেশ শক্তিশালী ছিল। কেউ জমিয়ত করত, আবার কেউ মজলিস করত। সিলেটের রাজনীতি একসময় এই দুটি দলই নিয়ন্ত্রণ করত। বর্তমানে এই দুটি সংগঠন ভেঙে চার টুকরো হয়েছে। যার কারণে তাদের কোনো কার্যক্রম এখন আর আগের মত সিলেটের রাজনীতিতে প্রভাব ফেলতে সক্ষম নয়। কওমী মাদরাসাগুলোতেও দল দুটি নিষ্ক্রিয়। মাদরাসার ছেলেরা এখন সংগঠনমুখী নয়। কারণ তারা এখান থেকে কিছুই পাচ্ছে না। এ কারণে তাদের সাংগঠনিক কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়েছে। একটা মিছিল পর্যন্ত বের করতে পারে না। আগে বড় বড় প্রতিবাদ মিছিল নিয়ে রাস্তায় বের হওয়া যেত। কিন্তু এখন আপনি কোনো মিছিলই দেখবেন না। পত্রিকায় বিবৃতি দেওয়ার মধ্যেই তাদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে।

সত্যসমাগত: শাপলা চত্বরের ঘটনায় হেফাজতের সঙ্গে জামাত-শিবিরের অবস্থান আমাদের ছেলেদেরকে বুঝিয়েছে, জামাত এখন আর কোনো ক্ষতির কারণ নয়। ভবিষ্যতের জন্য ভাবনাটা কতটুকু অনুকূলে?

মুসলেহুদ্দীন রাজু: এটা এখন কারো কারো কাছে ভালো মনে হলেও ভবিষ্যতের জন্য কতটুটু ভালো ফলাফল বয়ে আনবে সে ব্যাপারে আমি সন্দিহান। কারণ আমাদের ওলামাদের সঙ্গে জামায়াতের দ্বন্দ্ব যেই আকিদা-বিশ্বাস থেকে জামায়াত কি তা থেকে সরে এসেছে? না আমরা আমাদের অবস্থান পাল্টিয়েছি? যদি জামায়াত সরে আসে তবে তা হবে আমাদের জন্য প্লাস পয়েন্ট। আর যদি তাদের এই সরে আসাটা রাজনৈতিক কৌশল হয়, তবে তা আমাদের জন্য ক্ষতিকর। তবে এটা ঠিক কওমী মাদরাসার প্রতি তারা যে একটা বিরূপ মনোভাব পোষণ করত এতদিন, সেটা অনেকটাই কমে এসেছে। পলিটিক্যালি বিষয়গুলো যাই হোক, আকিদা-বিশ্বাসগত ব্যাপারগুলোতে পরিস্কার হওয়া দরকার। কারণ রাজনৈতিক পরিকল্পনার দিক থেকে জামায়াত আমাদের থেকে এগিয়ে, এটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না।

সত্যসমাগত: আপনার আব্বার সম্পর্কে কিছু বলুন!

মুসলেহুদ্দীন রাজু: তার ভেতরে আমরা সব গুণই কমবেশি দেখতে পেতাম। সহনশীলতা তার চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল। তার নিকট মুসলমানরা যেমন আসত, তেমনি এলাকার বিধর্মীদের প্রতিও তিনি যথেষ্ট আন্তরিক ছিলেন। শুধু ওয়াজ-মাহফিলে যেতেন এমন নয়। নিম্ন পর্যায় থেকে শুরু করে এমপি-মন্ত্রী পর্যায়ে সকলের সঙ্গেই তার চলাফেরা ছিল অবাধ। ২০০১-এর নির্বাচনে মৌলভীবাজার-সদর আসন থেকে আওয়ামী লীগের এক প্রার্থী আব্বাকে নিয়ে গেছে তার বাসায় খতম ও দোয়ার জন্য। আব্বা তখন জোরে জোরে দোয়া করতে লাগলেন ‘ইয়া আল্লাহ, হাসিনাকে তুমি ধ্বংস কর।’ এই দোয়ার কারণ, তখন বি-বাড়িয়ায় আওয়ামী লীগাররা আলেমদের হত্যা করছে। আব্বা বার বার এই দোয়া করতে লাগলেন। এমপিও তখন বাধ্য হয়ে আমীন আমীন বলতে লাগল। দোয়া শেষে এমপি তাকে বলল, হুজুর! আমি তো এ বছর আসন চাইছি। তখন আব্বা বললেন, না, তোমার এই মুহূর্তে এমপি হওয়ার কোনো দরকার নেই। সত্যিই সেবার সে আর আসন পায়নি। গত নির্বাচনে অবশ্য জিতেছে। বর্তমানে রানিং এমপি। আব্বা ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতি করতেন। তার শিক্ষার শুরুটা সম্পন্ন হয়েছে আলিয়া মাদরাসায়। এবং কর্মজীবনটাও শুরু হয়েছিল আলিয়া মাদরাসা থেকে। সত্তরের দশকে তিনি একজন পরিপূর্ণ রাজনীতিবিদ ছিলেন। রাজনীতি করেছেন জেনারেল ওসমানীর সঙ্গে। সত্তরে তিনি জেনারেল ওসমানীর সঙ্গে নির্বাচন করেছেন। রাজনৈতিকভাবে তিনি যে চিন্তা-ভাবনা করতেন, তা এখনকার ইসলামী রাজনীতিবিদরা করেন না। তিনি সরাসরি কথা বলতেন। কোনো ভয় পেতেন না। ওসমানীও আব্বাকে প্রচুর সমীহ করতেন। রাস্তার একদিক থেকে জেনারেল ওসমানী আসছে অন্যপাশ দিয়ে দিব্যি আব্বাও আসতেন। কিন্তু একজন অন্যজনকে সম্মান করতেন। শ্রদ্ধা করতেন। বর্তমান রাজনীতিতে এই জিনিশটা পাবেন না। এখনকার আলেমদের সামাজিক সম্পৃক্ততা কম, রাজনীতির পড়াশোনা কম। কিন্তু আব্বা এই সবগুলো দিক নিজের সঙ্গে সার্থকভাবে সমন্বয় ঘটাতে পেরেছিলেন। এখন সমাজে আলেমের সংখ্যা প্রচুর। কিন্তু সবক্ষেত্রে ওলামারা এখন আগের মতো গ্রহণযোগ্য হতে পারছে না, তার কারণ তারা সবকিছুর সঠিক সমন্বয় সাধন করতে ব্যর্থ হচ্ছে।

সত্যসমাগত: ইসলামী আন্দোলনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গণবিপ্লব না অন্যকোনো পন্থা প্রযোজ্য মনে করেন?

মুসলেহুদ্দীন রাজু: হ্যাঁ, গণবিপ্লব। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও পট-পরিবর্তনের জন্য গণবিপ্লবের বিকল্প নেই।

সত্যসমাগত: গণবিপ্লবের জন্য তো গণসম্পৃক্ততা প্রয়োজন। ইসলামী দলগুলোর কি সে পরিমাণ গণসম্পৃক্ততা রয়েছে?

মুসলেহুদ্দীন রাজু: বলতে হবে, নেই। বাংলাদেশের ইসলামী দল আর সাধারণ দলগুলোর মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। আওয়ামী লীগ-বিএনপি যেমন, তারাও তেমন। যেমন আপনাকে বলি, গত টার্মে আমাদের চারজন এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। ফতোয়া বিরোধী আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে যেয়ে বি-বাড়িয়ায় একাধিক ভাই শহীদ হয়েছেন। ওই আন্দোলনের ফলাফল হিসেবে তারা এমপি নির্বাচিত হন। অথচ দেখেন, তারা সংসদে গেলেন, কিন্তু একটিবারের জন্যও ওই পরিবারগুলোর খোঁজ নিতে যান নাই। তাদেরকে কোনো আর্থিক সহায়তা বা অনুদানও দেন নাই। এমনকি তারা সরকারে পুরো সময়টা জুড়ে ওই অবাঞ্চিত রায়টি বাতিলও করাতে পারেননি। পরের টার্মে আওয়ামী লীগ সরকার এসেই ওই রায়ের সমাধান দিয়েছে। আমি বলব, এটা বিএনপির ব্যর্থতা নয়, বরং আমাদের ব্যর্থতা। এখন যে জোটের কথা বলা হচ্ছে, কেউ কিন্তু বলছে না যে যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের শানে বেয়াদবি করছে তাদের ফাঁসির বিধান করে আইন পাস করতে হবে এবং তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে স্পষ্টভাবে ওই ঘোষণাও দিতে হবে, তবেই জোট হতে পারে। ইসলামী দলগুলো আছে যার যার নিজের চিন্তায়। এখন আপনিই বলুন, একজন সাধারণ এমপির চেয়ে এই এমপিদের কোনো ভিন্নতা আছে? অন্যরা এমপি হলে যে কাজ করেন, আমাদের এমপিরা তো ব্যতিক্রমী কিছু দেখাতে পারছেন না। তাহলে জনগণ আপনার ওপর কেন আস্থা রাখবে? আমাদের রাজনীতিতে ইসলামের চর্চা নেই। পর্দা, মুআমালাত, মুআশারাত এবং জামাতে নামাজ আদায়ের মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে আমাদের ঢিলেঢালা ভাব।

সত্যসমাগত: আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী?

মুসলেহুদ্দীন রাজু: শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আমার কিছু প্লান আছে। এটা শুধু সিলেটকেন্দ্রিক নয় বরং পুরো বেফাক বোর্ডকেন্দ্রিক। আমার ইচ্ছা আমরা ইংল্যান্ডের সিলেবাসটা ফলো করব। অথবা ইউরোপে যে সমস্ত বড় মাদরাসাগুলো আছে, সেগুলোকে অনুসরণ করে নিজেদের সিলেবাস পুনর্গঠন করব। স্বীকৃতির ব্যাপারেও বেফাকের এক মিটিং-এ আমি বলেছিলাম, পাকিস্তান বা ভারতের মত নয়, বরং ইংল্যান্ডের আদলে স্বীকৃতি চাওয়া যেতে পারে। তাতে বরং ভালোই হয়। কারণ বাঙালিরা উৎসাহী জাতি। তারা মনে করবে, আরে আমাদের দেশের কওমী মাদরাসাগুলো তো শেষমেষ ইংল্যান্ডের আদলে হয়েছে! বাস্তবিক অর্থেও আমি দেখেছি, বর্তমানে ব্রিটেনে যে মাদরাসাব্যবস্থা রয়েছে, তাদের মান এখন বেশ ভালো। এলেমের সঙ্গে সঙ্গে তাদের আমল-আখলাকও যথেষ্ট উন্নত।

সত্যসমাগত: এ ক্ষেত্রে তো আগে তাদের সিলেবাস বুঝতে হবে। এ রকম কোনো অভিজ্ঞ লোক আপনাদের আছে, যে সিলেবাসের ব্যাপারে এক্সপার্ট?

মুসলেহুদ্দীন রাজু: হ্যাঁ, ওই দেশের বেশ কিছু মাদরাসার পরিচালকের সঙ্গে আমি ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত। ইউরোপ ও দক্ষিণ আফ্রিকায় যে পাঠদান পদ্ধতি রয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে আমরা তা ফলো করতে পারি।

সত্যসমাগত: এ ব্যাপারে বেফাক কতোটুকু উৎসাহী?

মুসলেহুদ্দীন রাজু: বেফাকের কিছু কিছু কর্মী আছে যারা মোটামুটি আপডেটেড। যেমন আমাদের প্রবেশপত্রে ছবি নেই। গতবছর যে মিটিং হয়েছিল হাটহাজারীর হুজুরও ছিলেন। তখন আমরা কয়েকজন জিজ্ঞেস করলাম, আমরা তো দেওবন্দের অনুসারী। তো ওখানে প্রবেশপত্রে ছবি সংযুক্ত আছে কি না? তখন উত্তর দেওয়া হল, হ্যাঁ ছবি দেওয়া আছে। হাটহাজারীতে আছে কি না? আগে ছিল না, এখন শুরু হয়েছে। তখন আমরা বললাম, সব মাদরাসার প্রবেশপত্রে ছবি থাকলে বেফাকের প্রবেশপত্রে ছবি থাকবে না কেন? তখন কেউ কেউ বললেন, হ্যাঁ, তোলা যাবে, কিন্তু শুধু ছাত্রদের ছবি তোলা যাবে। মহিলা মাদরাসার ছাত্রীদের ছবি তোলা যাবে না। পরে বেফাকের আরেক সিনিয়র ছিলেন তিনি বললেন, হ্যাঁ, ছাত্রীদের ছবিও লাগবে। তিনি তখন বললেন, মেয়েদের ছবি আপনি দেখবেন কেন? আপনার দেখা তো জায়েজ হবে না। মেয়েদের ছবি দেখবে মেয়ের নির্বাচক বা পরীক্ষক যারা থাকবেন, তারা। আসলে পরিবর্তনের একটা চিন্তা-ভাবনা এখন সবার মধ্যেই কাজ করছে। তবে দেশের সার্বিক দিক পর্যালোচনায় সময়টা আমাদের অনুকূল নয়। তারপরও আমি আশাবাদী।

সত্যসমাগত: ভালো হত এই মুহূর্তে নিজেদের একটা মিডিয়া থাকলে।

মুসলেহুদ্দীন রাজু: মিডিয়া থাকাটা উচিত ছিল ঠিক। কিন্তু মিডিয়া যে আমাদের হাতে একেবারেই নেই, তা বলা যাবে না। ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে এলাকাভিত্তিক মসজিদ মাদরাসাগুলো যাদের হাতে, তাদের মিডিয়া যে একেবারেই নেই তা বলা যাবে না। কিন্তু বর্তমানে আমাদের যেটার বেশি অভাব অনুভূত হচ্ছে, তা হল আমাদের মধ্যে ব্যবহারিক জীবনে ইসলাম চর্চাটা হারিয়ে যাচ্ছে। অনেকে মুফতি হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু নামাজের প্রতি যত্নশীল হচ্ছে না। এ জন্য লেখাপড়া ও সামাজিক জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি আমলের ব্যাপারেও যত্নশীল হওয়া দরকার। বর্তমান মিডিয়ার যুগে আমাদেরও একটা মিডিয়ার প্রয়োজন আছে। বেফাক থেকে একবার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এক সাবেক এমপি এর যাবতীয় ভারও গ্রহণ করেছিলেন। আমি তখন মিটিংয়ে এর ঘোর বিরোধিতা করেছিলাম। বিরোধিতা করার কারণ হল, এই মুহূর্তে পত্রিকা প্রকাশ করলে তারা হয়তো সেখানে খেলার খবর দেবে না, বিনোদনের পৃষ্ঠা থাকবে না, ছবি ছাপা হবে না। এমন অনেক কিছুই হবে। তখন সে পত্রিকা কে পড়বে? যদিও পত্রিকার দ্বারা আমাদের উদ্দেশ্য হল, বাইরের কিছু পাঠক যোগান, কিন্তু তা হবে না। পত্রিকা কেবল আমাদেরকেই পড়তে হবে। এটা লসের একটা দিক। আবার পত্রিকা বের হলে তখন দেখা যাবে দ্বায়িত্বশীলরাই অন্তঃকলহে ভুগবেন। কারণ একজন সফরে যাবে তো তার সফরনামাটা পত্রিকায় দিতে চাইবে। মাহফিলের মৌসুমে মাদরাসাগুলো বলবে আমাদের ছবিসহ মাহফিলটা অথবা বড় কোনো বক্তা কোনো মাহফিলে গেছেন তো তার ছবিসহ মাহফিলের খবরটি বড় করে পত্রিকায় ছাপাতে চাইবে। কারো সংবাদ আগে-পিছে হলে বা কলেবরে বড়-ছোট হলে ঘোরতর সমস্যা সৃষ্টি হবে। এর চেয়ে আমার প্রস্তাব হচ্ছে, আমাদের স্বপক্ষে দু’একটি দৈনিকের সঙ্গে একটা চুক্তিতে আসা যেতে পারে। তারা যেন আমাদের সাপোর্ট দেয়। তখন হয়তো একটা পর্যায়ে গিয়ে আমরা পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নিতে পারি। এতে আমাদের অভিজ্ঞতাও বাড়বে, পাঠকও মিলবে। পাকিস্তানের জাতীয় দৈনিকগুলোর মধ্যে পাঠক চাহিদায় তৃতীয় স্থানে থাকা পত্রিকাটি সম্পূর্ণ আলেম-ওলামাকেন্দ্রিক।

সত্যসমাগত: সবশেষে আমার যেটা মনে হয়েছে, আপনাদের মত যারা নতুন করে কিছু ভাবছেন, দেশব্যাপী তাদের একটা কমিউনিটি কমপক্ষে যোগাযোগ থাকা দরকার। আপনি হয়তো সিলেটে আছেন, আরেকজন রাজশাহীতে, অন্য আরেকজন হয়তো দেশের অন্যপ্রান্তে। সবার চিন্তা এক হলেও যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার কারণে তা শেয়ার করতে পারছে না। অথচ বর্তমানে যোগাযোগ রক্ষা করা কোনো ব্যাপারই না।

মুসলেহুদ্দীন রাজু: আপনি ঠিকই বলেছেন। আমার জানা মতে, দেশের বিভিন্ন জায়গায় অনেকেই সামাজিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় আছে। আমি বিশ্বাস করি দেশে এমন মেধাবী আলেম প্রচুর আছে। এখন শুধু পরিচিত হওয়া এবং পারস্পরিক যোগাযোগ রক্ষা করা বাকি। এর জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। আমরা তো বড়ো অধৈর্য আর নিজেদের সুবিধা নিয়ে ব্যস্ত। পরবর্তী প্রজন্ম নিয়ে ভাবনা চিন্তার লোকের বড়ই অভাব।

সত্যসমাগত: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ

মুসলেহুদ্দীন রাজু: আপনাকেও ধন্যবাদ।

You may also like

প্রকাশক : মানজুর এলাহী

সম্পাদক : হামীম কেফায়েত

ব‌ইচিত্র পাবলিশার্স
প্যারিদাস রোড, বাংলাবাজার, ঢাকা ১১০০
যোগাযোগ : +8801712813999
ইমেইল : news@dhakabarta.net